Tuesday, April 12, 2011

সবুজ অরণ্য, হলুদ স্মৃতি


গোরুমারার পথে ছবি:সৌগত চ্যাটার্জী
 কৌশিক সরকার
চির সবুজের দেশ জলপাইগুড়ি।অরণ্য এখানে আদিম, এখনও অনেকাংশেই অকৃত্রিম।বৈচিত্র তার পরতে পরতে।বীরভূমের প্রকৃতি বর্ণনায় প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন, ‘ইহার এক দিকে প্রান্তর, অন্য দিকে বন; এক দিকে নগ্নতা, অন্য দিকে আচ্ছাদন; এক দিকে নিঃস্বতা, অন্য দিকে সম্পদ। ইহার পশ্চিমে শাল পিয়াল মহুয়া, পূর্বে আম জাম কাঁঠাল; পশ্চিমে তাল, পূর্বে খেজুর; পশ্চিমে অর্জুন, পূর্বে বাঁশ। ইহার এক দিকে সন্ন্যাস, অন্য দিকে গার্হস্থ্য ; এক দিকে ঘরছাড়া বনস্পতির দল, আর-এক দিকে ঘর ঘেঁষা উদ্ভিদের শ্রেণী। ইহার মাঝখানে দাঁড়াইলে দেখিবে পূর্ব দিগন্ত পর্যন্ত একটানা ধান্যশীর্ষের স্নিগ্ধ শ্যামলতা আর পশ্চিমে সূর্যাস্তের সীমা পর্যন্ত রক্ত মাটির বিবর্ণ ধূসরতা। এক দিকে কঠোর দৃঢ়-পিনব্ধ নিশ্চপল স্তব্ধতা; অন্য দিকে শ্যামলে কোমলে উর্বরে বৈদগ্ধ্যে নর্মলীলা। এক দিকে তপঃসংযত বিশ্বামিত্র, আর-এক দিকে সেই তপ ভাঙাইবার জন্য মেনকা; ইহার পূর্বচক্রবালে বনলেখাবগুন্ঠনের নীলিমা, আর পশ্চিম প্রান্তর হা-হা শব্দে বিরাট বৈরাগ্যে ধ্বনিত হইয়া বনরেখাহীন অসীম শূন্যতার মধ্যে মিলিয়া গিয়াছে।’ বস্তুত, জলাপাইগুড়ির রূপ প্রকৃতিতেও মেলে এই বৈপরীত্য, যার অপার বৈচিত্র্যময় সম্ভার লুকিয়ে রয়েছে জেলার আনাচে-কানাচে।
দাঁতাল ছবি: রবীন গোলদার
এই স্থান দেখেই এক সময় (১৭৭৫ সাল) ভূটানে ব্রিটিশের প্রতিনিধি জর্জ বোগলে মন্তব্য করেছিলেন, দুর্গম অসাস্থ্যকর এই এলাকা জয়ের কোনো দরকার নেই।এখানে লাভজনক কিছু করা যাবে না। অথচ, ১৮৩১ সালে হজসন রিপোর্ট দিলেন,ডুয়ার্সে চা-চাষ দারুণ লাভজনক হবে। ১৮৩৯ সালে পেমবার্টন বললেন, ডুয়ার্সে পৃথিবীর সেরা চা উৎপাদন সম্ভব। তার পরের ইতিহাস অনেকটাই জানা।১৮৭৪ সালে গজলডোবা টি এস্টেট চালুর মধ্যে দিয়ে যে পথ চলার শুরু, আজ জেলার অন্যতম পরিচয়ই হয়ে উঠেছে সেই চা-ই। অন্যতম আয়ের পথও। শুধু জলপাইগুড়িই নয়, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং এবং উত্তর দিনাজপুর জেলারও বিশেষত ইসলামপুর মহকুমা জুড়ে তার বিস্তৃতি।এক সময়, যে এলাকাকে চিহ্ণিত করা হয়েছিলো, পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর কলকাতা এবং বর্ধমানের কয়লা খনি এলাকা ছাড়া এই বাংলার যে এলাকায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুঁজি সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছিলো, তা হলো পাহাড়, তরাই এবং ডুয়ার্সের চা-বাগান এলাকা।

কুলীকের পরিযায়ী শামুকখোল ছবি: অমিত কর
বৈচিত্র্য এখানের ভূ-প্রকৃতিতে।বৈচিত্র্য এখানে জনজাতির চরিত্রে।বৈচিত্র্য এখানের ভাষায়, বৈচিত্র্য ধর্মে। বৈচিত্র্য আয়ের উৎসে, বৈচিত্র্য জীবন চর্চায়।এক জলপাইগুড়ি জেলাতেই রয়েছে প্রায় প্রতিটি ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ। অথচ, জনসংখ্যার তুলনায় এই জেলায় পুরানো ধর্মীয় স্থানের সংখ্যা নিছকই হাতে গোনা। এই জেলাতেই রয়েছে অন্তত ২৬ রকম জনজাতির বাস। তাদের ব্যবহৃত ভাষা-উপভাষার সংখ্যা ১৫১ টি, যার মধ্যে ৮ টি বহিরাগত ভাষা, ৪২ টির এখনও বর্গীকরণ হয়নিজলপাইগুড়ি, কোচবিহার আর দার্জিলিং জেলায় রয়েছে আটটি জাতীয় উদ্যান কিংবা অভয়ারণ্য। এছাড়াও উত্তর দিনাজপুরে রয়েছে কুলীক পক্ষী নিবাস।
উত্তর সীমান্ত বরাবর সিঞ্চুলা পাহাড় আর পূবে আসামের মানস জাতীয় উদ্যান। মধ্যবর্তী প্রায় ৭৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জলপাইগুড়ির বক্সা জাতীয় উদ্যান।উত্তর প্রান্তে ভূটানের ফিপসু অভয়ারণ্যে মিশছে বক্সা, যা হাতিদের আন্তর্জাতিক করিডর। বক্সার দক্ষিণ-পশ্চিমে চিলাপাতার জঙ্গল, যে জঙ্গল পেরিয়ে হাতির পাল পৌঁছায় জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে।জলদাপাড়া, চিলাপাতা এবং বক্সা, জলপাইগুড়ির আলিপুরদুয়ার মহকুমারই অন্তর্গত। মহকুমা সদর আলিপুরদুয়ার থেকে বক্সার অন্যতম প্রবেশদ্বার রাজাভাতখাওয়ার দুরত্ব ১৫ কিলোমিটার আর চিলাপাতা ২০ কিলোমিটার। চিলাপাতা থেকে হাসিমারার দুরত্ব খুবই কম, আর সেখান থেকেই মাদারিহাট হয়ে পৌঁছানো যায় জলদাপাড়ার গভীর জঙ্গলে। জলদাপাড়া থেকে গোরুমারার দুরত্ব ৬২ কিলোমিটার। তার হাতের নাগালেই রয়েছে চাপড়ামারি অভয়ারণ্য।  আবার শিলিগুড়ির সুকনা থেকেই শুরু হচ্ছে মহানন্দা অভয়ারণ্য। শিলিগুড়ি থেকে তিস্তার পার ধরে গ্যাংটকগামী রাস্তা দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় কালীঝোড়া, রংপো।বাংলা-সিকিম সীমান্তের রংপোতেই তিস্তার সঙ্গে মিশেছে রঙ্গিত। আর দার্জিলিঙ জেলারই দার্জিলিঙ মহকুমায় রয়েছে সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান এবং কালীম্পং মহকুমায় ন্যাওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যান।
মূর্তি নদীর ধারে পর্যটক আবাস ছবি: শ্যামল মজুমদার
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকার মধ্যেই রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। আলিপুরদুয়ারকে কেন্দ্র করেই যেগুলিতে পৌঁছানো সুবিধাজনক।জয়ন্তী (৩০ কিলোমিটার), বড়ডাবরি (২৫ কিলোমিটার), নিলপাড়া ( ২৭ কিলোমিটার), চিলাপাতা ( ২০ কিলোমিটার), কোদালবস্তি (২২ কিলোমিটার), বাংলা-আসাম সীমান্তে বারবিশা শিলবাংলো ( ৪৫ কিলোমিটার), বাংলা-ভূটান-আসাম সীমান্তে কুমারগ্রাম ( ৬৫ কিলোমিটার), রায়মাটাং (৪৫ কিলোমিটার), নিমাতি (১৭ কিলোমিটার), রাজাভাতখাওয়া (১৫ কিলোমিটার),সান্ত্রাবাড়ি,বক্সাদুয়ার আলিপুরদুয়ার থেকেই কুমারগ্রামগামী রাস্তায় কামাক্ষ্যাগুড়ি হয়ে যাওয়া যায় তুফানগঞ্জের আটিয়ামোচড়, যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে রসিকবিল। বিশেষ করে পরিযায়ী পাখীর জন্য পরিচিত এই রসিকবিল।কোচবিহার থেকেও যাওয়া যায় সেখানে।

চারখোল থেকে চুইখিমের পথে ছবি: সৌগত চ্যাটার্জী
তবে বড়ডাবরি, চিলাপাতা, কোদালবস্তি হাসিমারা থেকেও যাওয়াও সুবিধাজনকজলপাইগুড়ি থেকে হাসিমারার দুরত্ব ৭৫ কিলোমিটার আর আলিপুর দুয়ার থেকে হাসিমারার দুরত্ব ২৫ কিলোমিটার।হাসিমারা থেকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছানো যায়, বাংলা-ভূটান সীমান্ত জয়গাঁ।সেখানেই রয়েছে ভূটানের প্রবেশদ্বার। ওপারেই ভূটানের সীমান্ত শহর ফুন্টশেলিং।সেখান থেকে রাস্তা গেছে ভূটানের পাহাড়ি শহর ও পুরানো রাজধানী পারো এবং বর্তমান রাজধানী থিম্পু।
অন্যদিকে,জেলা সদর অন্যদিকে,জলপাইগুড়ি থেকে গোরুমারার দুরত্ব ৫০ কিলোমিটার আর চাপড়ামারির দুরত্ব ৬৫ কিলোমিটার।গোরুমারার অদূরেই গড়ে উঠেছে লাটাগুড়ি প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। তার দুই থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে চাপড়ামারি, শিবচু, বান্দাপানি, নাথুয়া, খুট্টিমারি এবং গোরুমারা।আবার, লাটাগুড়ি অথবা মহকুমা সদর মালবাজারের থেকেও স্বল্প দুরত্বে রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। মালবাজার, চালসা, মূর্তি,চাপড়ামারি, গোরুমারা, সামসিঙ, সুনতালেখোলা, ঝালং, বিন্দু, গেহনবাড়ি এমনকি গরুবাথান পাহাড় হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ। সামসিঙ থেকে ন্যাওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানও কাছেই।আবার মালবাজার থেকেই সেবক রোড হয়ে চলে যাওয়া যায় শিলিগুড়িও।জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার মাদারীহাট, আর মাদারীহাট থেকে ৭ কিলোমিটার ভিতরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের হলং বাংলো। মাদারীহাট থেকে কাছেই খয়েরবাড়ি।আর মাদারীহাট থেকে টোটোপাড়ার দুরত্বও ২২ কিলোমিটার। জলপাইগুড়ি থেকে যাওয়া যায় ময়নাগুড়ির কাছে জল্পেশ ,আমবাড়ি, শিকারপুর জঙ্গলের কাছে বোদাগঞ্জেও।

অর্কিড ছবি:সৌগত চ্যাটার্জী
দার্জিলিঙ জেলাতেও কার্শিয়াঙ, কালিম্পং এবং দার্জিলিঙ ছাড়াও রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র। মিরিক,লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ তো রয়েছেই।আছে লেপচাজগৎ, রিম্বিক, মংপঙ, রোহিনী, রাম্মাম,মংপু, শ্রীখোলা, পালমাজুয়ার মতো কেন্দ্রগুলিও।এছাড়াও গড়ে উঠেছে তিনচুলে, চুইখিমের মতো কেন্দ্রগুলিও।
অপাপবিদ্ধ  ছবি: সৌগত চ্যাটার্জী
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প, যা জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পেয়েছে ১৯৯৭ সালে, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর এক বিরাট বৈচিত্র্যময় সম্ভার রয়েছে তাতে।এখানে রয়েছে ১০৮ প্রজাতির লতা, ১৩৩ প্রজাতির গুল্ম, ৩৫২ প্রজাতির বৃক্ষ,১৪৪ প্রজাতির অর্কিড,১১২ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদজলজ উদ্ভিদই রয়েছে ১৩০ প্রজাতির, একবীজপত্রী এবং ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে প্রায় ১৬০ টি প্রজাতির।বাঁশই মেলে দশটি প্রজাতির, বেত নটি প্রজাতির।শাল, সেগুন, চাপ, গামার, শিমুল, চিকরাশি-র বিপুল সম্ভার এখানে।শুধু পাখীই রয়েছে ২৪৬ প্রজাতির, স্তন্যপায়ী ৬৮ প্রজাতির, সরীসৃপ ৪১ প্রজাতির,মাছ ৩৬ প্রজাতির।রয়েছে রং-বেরঙের প্রজাপতি।(সূত্রঃ রাজাভাতখাওয়া প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র)বক্সায় মেলে শাদা-পীঠ শকুন, জংলী মুরগী, নীল পায়রা, গোলাপী-বুক টিয়া, লং টেইলড নাইটজার, নীল মাছরাঙা, স্মল গ্রীন বি-ইটার, বড় বসন্ত, কসাই পাখী, ভীমরাজ,ফিঙে, হেয়ার ক্রেসটেড ড্রোংগো, ঝুটি শালিখ, জাঙ্গল ময়না,হাঁড়িচাচা, দাঁড়কাক,ছাতারে, গ্রে বুলবুল, রেড ভেন্টেড বুলবুল, হলদে পেট চাকদোয়েল, নীল কটকটিয়া, সাদা কালো চুটকি,কস্তুরা, সাদা খঞ্জন,ঘুঘু সহ নাম জানা ও না-জানা বহু পাখী।রয়েছে চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন, অ্যান্টিলোপ, রিগাল পাইথন,অসংখ্য ময়ূর,সজারু, বাঁদর,শুয়োর,হরিণ,বন বিড়াল, চিতাবাঘ এবং বাঘও।বক্সা আর চিলাপাতা জঙ্গলে এখনও এমন বহু এলাকা রয়েছে যেখানে আজও মাটিতে পৌঁছায় না সূর্যের আলো।হাতি, বাইসন, হরিণ, ময়ূরসহ জীব বৈচিত্র্যের ভালো সম্ভার রয়েছে চিলাপাতাতেও। এখানে রয়েছে এক ধরণের বৃক্ষ, যাতে আঁচড় কাটলে রস গড়ায় তাজা রক্তের মতো।নল রাজার গড়ের আশেপাশে রয়েছে এই প্রজাতির গাছগুলো। জলদাপাড়া অভয়ারণ্য বিখ্যাত তার এক শৃঙ্গ গন্ডারের জন্য। আসামের কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের পরেই ভারতে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক এক শৃঙ্গ গন্ডার মেলে এই জলদাপাড়াতেই। ১৪১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট এই অভয়ারণ্যজলদাপাড়া থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। ৯৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই গোরুমারাতেই রয়েছে ১৯৩ প্রজাতির পাখী,২২ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৭ প্রজাতির মাছ।জলদাপাড়ায় রয়েছে ৮টি প্রজাতির এবং গোরুমারায় রয়েছে ৭টি প্রজাতির কচ্ছপ।গত বছর সারা দেশের মধ্যে সেরা জাতীয় উদ্যানের শিরোপা পেয়েছে এই গোরুমারা জাতীয় উদ্যানইওয়াইল্ড লাইফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইকনমিক রিহ্যাবিলিটেশন-এ ১০০-র মধ্যে ৮৬ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে ৯৮ বর্গ কিলোমিটারের গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। ১৯৭৭ সালে যেখানে এই অরণ্যে একশৃঙ্গ গঙ্গারের সংখ্যা কমে হয়েছিল ৭টি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬টিতে। বাইসন, সম্বর, চিতল হরিণ, হাতি, লেপার্ড সবই কমেছিল। এখন বাইসন হাজার দেড়েকের বেশি। হাতি ৪০টি। চিতল হরিণ, লেপার্ড, সম্বর সবই বেড়েছে যথেষ্ট। আর তা পর্যবেক্ষণের জন্য এখন গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার। আগে ছিল মাত্র একটি, গোরুমারায়। এখন তারই সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে যাত্রাপ্রসাদ, মেদলা, চুকচুকি, চন্দ্রচূড়, চাপড়ামারি, কলোখাওয়ার মতো টাওয়ারগুলি। এর মধ্যে চুকচুকি ওয়াচ টাওয়ারটি গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষত পাখী পর্যবেক্ষণের জন্য। লাটাগুড়ি ছাড়াও পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে ধূপঝোড়া (লাটাগুড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার), বাতাবাড়ি (১২ কিলোমিটার), পানঝোড়া (৪৫ কিলোমিটার), রামসাই (২১ কিলোমিটার), কালীপুর বনবস্তি (১৮ কিলোমিটার) এবং বিচাভাঙা বনবস্তিতেও (২ কিলোমিটার)আর, লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে দুই থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে চাপড়ামারি (৪০ কিলোমিটার ভায়া মূর্তি), শিবচু (৩০-৩৫ কিলোমিটার), বান্দাপানি (৪০-৪৫ কিলোমিটার), নাথুয়া (৪০-৪৫ কিলোমিটার, যদিও হাতিরা যে পথে যায় তাতে দুরত্ব ৮-৯ কিলোমিটার), খুট্টিমারি (৩৫ কিলোমিটার), গোরুমারার (রাইনো টাওয়ার ১৩ কিলোমিটার)মতো অরণ্যগুলি।গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের কাছেই এবং চালসা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে চাপড়ামারি অভয়ারণ্য। বিশেষত হাতি, বাইসন, ময়ূর, হরিণ এবং বহু রকমের পাখীর দেখা মেলে চাপড়ামারিতে।বন বাংলো থেকেই ভোরবেলা এবং সন্ধ্যায় দেখা মেলে বন্যপ্রাণীর।
শিলিগুড়ি থেকে আধ ঘন্টার দুরত্বেই মহানন্দা অভয়ারণ্য। সুকনা থেকেই শুরু হচ্ছে ১৫৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট এই অভয়ারণ্য।উচ্চতম এলাকা লাতপানচার।উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার ফুট।শিলিগুড়ি থেকে তার দুরত্ব ৪৪ কিলোমিটার আর শিলিগুড়ি-গ্যাংটকগামী সড়কে কালীঝোড়া বাংলো থেকে তার দুরত্ব ১৩ কিলোমিটার।কালীম্পং মহকুমার নেওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যানের শিরোপা লাভ করে ১৯৮৬ সালেই। ৮৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই জাতীয় উদ্যানের উচ্চতম এলাকা রাচেলা ডান্ডা।উচ্চতা ১০ হাজার ৬০০ ফুট।সিকিম এবং ভূটান সীমান্তের এই জাতীয় উদ্যানটি পরিচিত ওক,ফার্ন,অর্কিড এবং রোডোডেনড্রনের জন্য। যেমন মহানন্দা অভয়ারণ্যে রয়েছে খয়ের এবং শিশুর বিপুল সম্ভার।বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী রেড পান্ডা ছাড়াও এখানে মেলে ক্লাউডেড লেপার্ড, মাস্ক ডিয়ারের মতো প্রাণী এবং কিং কোবরা, গ্রিন পিট ভাইপার, ব্লাইন্ড স্নেকও। কালিম্পং এবং লাভা থেকেই যাওয়া যায় এখানে। আবার চালসা, সামসিং থেকেও আসা যায় নেওড়া ভ্যালী অরণ্যে। নেওড়া নদীর উপত্যকা বলেই এর নাম নেওড়া ভ্যালী, যে নদী এলাকার জলেরও অন্যতম উৎস। কালিম্পং মহকুমার নেওড়া ভ্যালী ছাড়াও পাহাড়ের দার্জিলিং মহকুমাতে রয়েছে সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান। ৭৮.৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এবং প্রায় ৭ হাজার ফুট উচ্চতায় এই সিঙ্গালীলা ১৯৮৬ সালে অভয়ারণ্য হিসাবে এবং ১৯৯২সালে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পায়।এর মধ্যে দিয়েই বইছে রাম্মাম এবং সিরিখোলা (শ্রীখোলা) নদী।বাঁশ, ওক, ম্যাগনোলিয়া,রোডোডেনড্রন আর হরেক প্রজাতির অর্কিডের জন্য বিখ্যাত সিঙ্গালীলা।উত্তরে সিকিম এবং পশ্চিমে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই অরণ্য।মানেভঞ্জন থেকে সানদাকফু( ৩৬৩৬ মিটার) এবং ফালুট (৩৫৩৬ মিটার)পর্যন্ত ট্রেকিং রুটের জন্য পরিচিত এই সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান। উচ্চতম স্থান ১১ হাজার ৯১০ ফুট।রেড পান্ডা ছাড়াও হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার, লেপার্ড, ক্লাউডেড লেপার্ড, ওয়াইল্ড বোর, প্যাঙ্গোলিনের মতো প্রাণীগুলির জন্য পরিচিত এই অরণ্য।বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী রেড পান্ডার সংরক্ষণের জন্য ভারতে মোট ২০ টি স্থানকে নির্বাচিত করা হয়েছে, যার মধ্যে সিকিমের কাঞ্চনজঙ্ঘা জাতীয় উদ্যান, অরুণাচল প্রদেশের নামডাফা জাতীয় উদ্যান ছাড়াও রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান।সানদাকফুকে বলা হয়, ‘বিষাক্ত উদ্ভিদের পাহাড়’।মূলত, সানদাকফুর কাছে হিমালয়ান কোবরা লিলি-র আধিক্যের জন্যই তা বলা হয়।মার্চ-এপ্রিল এবং বর্ষার পরে অক্টোবর মাস নাগাদ রোডোডেনড্রন, ম্যাগনোলিয়া আর অর্কিডের ফুলে ছেয়ে যায় পাহাড়ী উপত্যকা।অন্যদিকে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের কাছে কুলীক নদীর ধারে কুলীক পক্ষী নিবাস পরিচিত প্রধানত পরিযায়ী পাখীর জন্য। বিশেষ করে অরণ্য জুড়ে যখন শামুকখোল পাখী বসে, মনে হয় সাদা সাদা থোকা থোকা ফুল ফুটেছে গাছগুলিতে।
জয়ন্তী ছবি: অমিত কর

বক্সা মানে শুধুই গা ছমছমে অরণ্য নয়। প্রকৃতি আর ইতিহাস এখানে যুক্ত অঙ্গাঙ্গীভাবে। জয়ন্তী থেকে পাহাড়ী ঝোড়া, কয়লা,গন্ধকের পাহাড় আর ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পৌঁছানো যায় মহাকাল।পাহাড়ের চূড়ায় মহাকাল মন্দির।আর চুনা পাথরের তিনটি প্রাকৃতিক গুহা।অন্ধকার সেই গুহায় হাজার হাজার বছর ধরে চুন আর জলের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাকমাইটের প্রস্তরীভূত সব মূর্তি। মোমের আলোয় সে গুহামূর্তি দেখা সত্যিই রোমাঞ্চকর।জয়ন্তী থেকে লেপচাখা হয়ে যাওয়া যায় বক্সা পাহাড়ে। অথবা সান্ত্রাবাড়ি (৯১৪ ফুট) থেকে পাহাড়ী পথে ৫ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছাতে হয় বক্সাদুয়ার।১৯৯৭ থেকে ২ কিলোমিটার গাড়ি যাওয়ার রাস্তা হয়েছে।কিন্তু তারপর হাঁটতেই হবে।এখান থেকে অনেকগুলি ট্রেকিং রুটও আছে।চুনাভাটি, তাসিগাঁও, রূপং,লেপচাখা, ওসেলুম, তাসিডিংকা, কাতলুং নদী এবং জলপাইগুড়ি জেলার সর্বোচ্চ পাহাড় তপগাঁ (৫,৬০০ ফুট)।বক্সাদুয়ারের সামরিক ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে দুর্গের পাশের পাহাড়ে রয়েছে আরো দুটি পিকেট-ম্যাগডালা হিল পিকেট এবং কনিকাল হিল পিকেট।চুনাভাটিতে রয়েছে একটি বহু প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফা এবং ১৮৯৪ সালে ফিনিশ মিশনের তৈরি একটি চার্চ।
বক্সাতে রয়েছে ঐতিহাসিক এক দুর্গেরও ভগ্নাবশেষ এবং তার ওপর ছোটো এক সংগ্রহশালা। ২,৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই দুর্গ।আর বক্সা বন বাংলো অবস্থিত ৩,০০০ ফুট উচ্চতায়।রোভার্স পয়েন্ট ৪,৫০০ ফুট। বক্সা থেকে ৪ কিলোমিটার ট্রেকিং করে রোভার্স পয়েন্ট এবং ১১ কিলোমিটার ট্রেক করে যাওয়া যায় ভূটানের রূপং উপত্যকায় (প্রায় ৬,০০০ ফুট)সিনচুলা রেঞ্জের ‘ জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন ’ বলা হয় রূপং উপত্যকাতে।রোভার্স পয়েন্টের আশপাশ দিয়েই বেরিয়েছে ডিমা, বালা, কাতলুং –র মতো ডুয়ার্সের নদীগুলি। নীচ দিয়ে বয়ে গেছে রায়ডাক নদী, ভূটানে যার নাম ওয়াং-চু।বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পেরই অন্তর্গত ভূটানঘাটের কাছেই ছিলো বন বাংলো। গভীর জঙ্গলে যেখান থেকেই শোনা যেত খরস্রোতা রায়ডাকের গর্জন।জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তিন চার কিলোমিটার পার হলেই মিলবে তিনদিকে পাহাড় ঘেরা একফালি উপত্যকা।পিপিং।সামনে দিয়েই বইছে ওয়াং-চু।তার ওপর ঝোলানো ব্রিজ। তিন দিকেই ভূটান। পাহাড়ে চাষ হয় কমলালেবুর।সেখান থেকে তা নামাননো হয় পিপিং-এ। কমলালেবুর মরসুমে সেখানে বসে অস্থায়ী তাঁবু। দু-চারটে চায়ের দোকান।বক্সাদুয়ারে যাবার অন্যতম পথ সান্ত্রাবাড়ির নামও হয়েছে এই কমলালেবু থেকেই।সনতলা মানে কমলালেবু, তার থেকেই সনতলাবাড়ি, যা অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সান্ত্রাবাড়ি। আবার ডুয়ার্সের আর এক পর্যটন কেন্দ্র সুনতালেখোলার নামও হয়েছে এই কমলালেবু থেকেই। আর বক্সা থেকে জয়ন্তীর দুরত্ব ১৩ কিলোমিটার।অন্যদিকে বক্সা দুয়ার জায়গাটি পরিচিত ছিলো ‘পাশাখা’ নামেও, যা একটি ভূটানী শব্দ, মানে ঘন অরণ্য।অন্যদিকে, চাপড়ামারি, ঝালং হয়ে বিন্দু পার হলেই শুরু ভূটান।পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা সেই এলাকা। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের পূর্ব ডিভিশনের কুমারগ্রামের কুমারগ্রাম আর সঙ্কোশ বিটের মাঝ বরাবার রাস্তা কিংবা জঙ্গলের পথ ধরে চলে যাওয়া যায় ভূটানের কালীখোলার জঙ্গলে।বাংলা-ভূটান-আসাম সীমান্তে সেখানে বইছে সঙ্কোশ নদী।
বক্সা দুর্গটি ঠিক কবে তৈরি হয়েছিলো, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিক রামরাহুলের মতে, মীরজুমলার আক্রমণের ভয়ে কোচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ এখানে লুকিয়ে ছিলেন ১৬৬১ তে, প্রায় বছর খানেক। দুর্গটি ভুটিয়া সম্প্রদায় তৈরি করে ডুয়ার্সে আক্রমণ চালাবার জন্য।ভূটান রাজের সাথে ঐ এলাকার যোগাযোগ ছিলো ক্ষীণ। আসল শাসন চালাতেন ঐ এলাকার সুবা। এই দুর্গটি ‘জং’ নামে পরিচিত।(সূত্রঃ The Himalayan As a Frontier)১৭৭৩ সালে এই দুর্গটি ক্যাপ্টেন জোনস অধিকার করলে এখানে ব্রিটিশদের নজর পড়ে। ১৮৬৪ তে দ্বিতীয় ভূটান যুদ্ধের শেষে ১৯৬৫ সালের ৯ নভেম্বর (মতান্তরে ১১ নভেম্বর) সিনচুলা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইংরেজ অধিকারে স্থায়ীভাবে আসে বক্সা , ১৮৬৫ থেকে তারা দুর্গটি সংস্কার করে।(অ্যাশলে ইডেন) ১৮৬৭-৬৮ পর্যন্ত বক্সা ছিলো মহকুমা সদর।তার পরবর্তীকালে কিছুদিনের জন্য তা স্থানান্তরিত হয় ফালাকাটায়, ফের ১৮৭৪-৭৫ সালে বক্সা পাহাড়ে।আর ১৮৬৯ সালের ১লা জানুয়ারি তৈরি হয় জলপাইগুড়ি জেলা।বক্সা এলাকার রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী পর্যন্ত মিটার গেজ রেললাইন পাতা হয় ১৯০১ সালে। তখন ছিলো বক্সা-জয়ন্তীর গৌরবের দিন।চুন, পাথর, কাঠের ব্যবসা।দিনে বার চারেক ট্রেন, বারবার বাস, তৈরি হয় স্কুল,পোস্ট অফিস, পাম্প হাউস,অফিসারদের থাকার ব্যবস্থা আর দুর্গ,যার একটি অংশ ব্যবহার করা হতো সেনা ছাউনি হিসাবে।তারও আগে ভূটানের সাথে ব্যাবসা বাণিজ্যের একটি পথ ছিলো বক্সা। ভূটান থেকে আসত চীনা রেশমী বস্ত্র,চামর, মৃগনাভি,টাঙ্গন ঘোড়া ইত্যাদি। যে টাঙ্গন ঘোড়ার সুখ্যাতি করা হয়েছিলো আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতেও। অন্যদিকে বাংলা থেকে ভূটানি ব্যাবসায়ীরা নিয়ে যেত নীল, লবঙ্গ, দারুচিনি, কর্পূর, তামাক প্রভৃতি।
১৯১৪ তে বক্সা দুর্গে মিলিটারি ছাউনি বসে ,আর উ‌ ঠে যায় ১৯২৪ সালে।বক্সা দুর্গ জেলখানা হয়ে ওঠে ১৯৩০ সালে।স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম পর্যায়ে ১৯৩০-৩৭ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৪২-৪৭ সাল পর্যন্ত চালু ছিলো বক্সা বন্দী শিবির।প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে সেখানে বন্দী ছিলেন ২৯৩ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী।স্বাধীনতার পরে কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনী ঘোষণা করা হলে ফের কমিউনিস্ট পার্টির বহু নেতা-কর্মীকে পাঠানো হয় বক্সায়।তৃতীয় দফায় বক্সা বন্দী শিবির চলে ১৯৫১ পর্যন্ত।সে পর্যায়ে বিনয় চৌধুরী, প্রশান্ত শুর, সুভাস মুখোপাধ্যায় সহ সেখানে বন্দী ছিলেন ৮৩ জন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মী। (সূত্রঃ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও অন্যান্য সূত্র থেকে তৈরি ‘মেঘের গায়ে জেলখানা ’ সংকলনটির সারণী)১৯৫১ পরবর্তী পর্বে ১৯৫৯ সালে তিব্বতি উদ্বাস্তুদের আশ্রয় শিবির হয় বক্সা।১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলে সেই শিবির। এরপর থেকেই বক্সা ক্রমশ চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।১৯৮৬ সাল থেকে বন্ধ হয়ে গেছে বক্সা-জয়ন্তী রেল।আর ১৯৯৩-র বন্যায় ভেসে গেছে রেল লাইন, পুরানো পূর্ত বাংলো,রেল আবাসন,রেল ব্রিজের খানিকটা অংশ।বন্ধ চুনাভাটির চুন সংগ্রহ, পাথর তোলা, পরিবেশের কারণে প্রায় বন্ধ ডলোমাইট তোলার কাজও।এই এলাকায় ডলোমাইটের বিপুল সম্ভার থাকার কারণে জয়ন্তী-হাতিপোতা আর বাংলা ভূটান সীমান্তের কাছে ভূটানঘাটে নির্বিচারে চলছিলো ডলোমাইট সংগ্রহের কাজ।আর ১৯৮৩ সাল থেকেই শুরু হয় বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কাজ।যার সম্পর্কে ১৮৮৯ সালেই ডুয়ার্সের সেটলমেন্ট অফিসার ডি এইচ ই সান্ডার লিখেছিলেন, No better idea of the forests in the Duars can be obtained than that which you may get almost throughout the year along the Alipur-Buxa Road, Here high Sal, Saj, Champ, Sida and other trees grow luxuriantly and line both sides of the road.’ আর গ্রুনিং-র বর্ণনায়, ‘The scenary near the hills, particularly where the Tista, Jaldhaka, Raidak and Sankos river debouch into the plains is very fine; west of the Torsa the wooded hills of Bhutan with Kinchinjanga in the background from a splendit picture, though the view changes further east where reserve forest intervene between the cultivated land and the hills, these forest are not without a beauty of their own. No better idea of the forest in Duars can be obtained than on the road between Buxa Road Station and Santrabari where the climb up to Buxa. Cantonment begins. Fine Sal trees abound and further north when the orchids are in bloom in March and April, the forests are very beautiful.'
সঙ্কোশ বনবস্তি ছবি : রবীন গোলদার
আবার বক্সার  দক্ষিণ-পশ্চিমে চিলাপাতা জঙ্গলের গড় মেন্দাবাড়িতে রয়েছে নলরাজার গড়ের ধ্বংসাবশেষ।প্রত্নগবেষকদের একাংশের অনুমান, এটি কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ নির্মাণ করেছিলেন। ইঁটের প্রাচীর দিয়ে দুর্গটি ঘেরা। বানিয়াদহ নদী দিয়ে ঘেরা দুর্গটিতবে এটি নরনারায়ণই নির্মাণই নির্মাণ করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে।এই দুর্গের চত্বরে বড় বড় পাথরের স্ল্যাব পাওয়া গেছে।দুর্গটির যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ষোড়শ শতাব্দীর দুর্গের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত বলে স্থানীয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা। ( আনন্দ গোপাল ঘোষ, পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত)
উত্তরবঙ্গের এই অরণ্যগুলিতে মেলে বেশকিছু বিশেষ জনজাতির উপস্থিতি। বক্সা পাহাড়ে যেমন মেলে ‘ড্রুকপা’ বা ‘ডুকপা ’ দের উপস্থিতি, তেমনই জলদাপাড়ার কাছে টোটোপাড়ায় মেলে আর এক আদিম জনজাতি ‘টোটো ’দের উপস্থিতি।এছাড়াও বনবস্তিগুলিতে মেলে মেচ, রাভা,তামাং, ওঁরাও,মুন্ডা, কোরা-র মতো জনজাতিগুলির উপস্থিতি।রয়েছেন লিম্বুরাও।সামগ্রিকভাবে বৈচিত্রময় জলপাইগুড়ির জনজাতিগুলিতে ভাগ করা হয় তিনটি ভাগে। যার মধ্যে রয়েছে ডোয়য়া, খোনিয়া, পানিকোচ, কিচক, জলদার মতো অধুনালুপ্ত মোঙ্গলয়েড জনজাতিগুলিও। তবে মোঙ্গলয়েড শেরপা, ডুকপা, টোটো, কাগাতে, ইউলমো, মেচ, রাভা, লেপচা, গারো, মগ,হাজং, লিম্বু, চাকমা ছাড়াও এই জেলাতেই মেলে ওঁরাও,মুন্ডা, সাঁওতাল, লোধা, শবর, মাহালি, নাগোশিয়া, মালপাহাড়িয়া, হো, বীরহড়, ভূমিজের মতো জনজাতিগুলি।
ভূটান, আসাম, নেপাল, সিকিমের রাজনৈতিক ইতিহাসের পটভূমি আর পূর্ব হিমালয়ের পর্বতমালা, গিরিবর্ত , গহন অরণ্যে ঘেরা প্রকৃতি, বন্যপ্রাণের বৈচিত্র্য আর জনজাতির জীবনযাত্রায় উত্তরবঙ্গের অরণ্য যেন আজও আদিম, ভয়ংকর সুন্দর, মায়াবী আর ভীষণ সবুজ।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: জলপাইগুড়ি জেলার পুরাকীর্তি (আনন্দ গোপাল ঘোষ), ঐতিহাসিক উপাদান ও দলিল চিত্রে জলপাইগুড়ি ( সুনীল চক্রবর্তী ), পর্যটনে জলপাইগুড়ি জেলা ( কৌস্তভ তরফদার), রূপময় জলপাইগুড়ি (জগন্নাথ বিশ্বাস), জলপাইগুড়ি জেলার জনজাতি ( বিমলেন্দু মজুমদার), পাখির স্বর্গে সাত দিন (রাজা পাল), স্বপ্নের রেলগাড়ি ও বকসা জয়ন্তী (অর্ণব সেন), জঙ্গল মহলে (শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়), দ্বিতীয় দার্জিলিং (তুষার প্রধান), কাঁটাতারের বেড়ায় (সুভাস মুখোপাধ্যায়), বন্দীতালিকা (মেঘের গায়ে জেলখানা সংকলন; সঙ্কলকঃ নরেশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ) এবং রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির সহ আরো কয়েকটি ওয়েবসাইট]




No comments:

Post a Comment