Friday, April 08, 2011

না-প্রেম , নাম তিস্তা

কৌশিক সরকার
সম্পর্কটা কেমন? সম্পর্কগুলো কেমন? সেকী এক না একাধিক? ভালোবাসার না না-প্রেমের?
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নাকি একই সুতোয় গাঁথা? নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করেছি বহুবার। একবার নয়, দুবার নয়, তিনবারও নয়, বহুবার।
ভেবেছি, সম্পর্কগুলো কেমন? তিস্তারই মতো নয় কী? যেন প্রায় সমান্তরালে বয়ে চলা এক নদী। কিংবা এক নারী। অথবা এক মন। চলার পথে কখনও-সখনও কাছে আসে। কথা বলে কানে কানে। পরমুহূর্তেই সহসা হারিয়ে যায় ঐ শাল, সেগুনের ভিড়ে। ফের যেন খানিক দুষ্টুমির ছলেই বলে, এই তো আমি। এই লুকোচুরিই যেন চলেছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। এই কাছে আসা, কানে কানে কথা বলা, ফের দূরে চলে যাওয়া, আবার কাছে আসা। ভেবেছি, ভালোবাসা কোনটা? আবেশ না অভ্যাস? বসন্তের সেই বাতাস-যা নেশা ধরায়! না কি সেই মেয়ে, যার উপস্থিতিই বয়ে আনে সেই বসন্ত বাতাসের অনুভূতি! প্রশান্ত, স্মিতহাস্য যে মুখের দিকে তাকালেই যেন বাতাস বইতে শুরু করে ধীর লয়ে। ছড়িয়ে পড়ে সেই প্রশান্তি, তৈরি হয় এক আবেশ।
ভেবেছি, ভালোবাসা কোনটা? এক ক‌ঠিন কর্তব্যবোধ না কি খাঁচাবন্দী এক পাখী? পৃথক সত্ত্বা অভিমানী কিন্তু প্রত্যয়ী কোনো ধারা না কি অভিসারে চলা বহমান অভিসারী ধারার কোনো একটি ধারা মাত্র? অন্তঃসলিলা বা অন্তঃশীলা- কোনো কিছুতেই যায় আসে না তার। ভেবেছি, ভালোবাসা কোনটা? নিভৃতের নগ্ন শরীরী আত্মসমর্পণ না কি অ-শরীরী মনের গোপন কাঙ্ক্ষিত আশ্রয়?
তিস্তা ছবি: শ্যামল মজুমদার
পাহাড়ী পথ আর তিস্তারই মতো যেন বয়ে চলেছে সম্পর্কগুলো। এক নয় বহু, সহস্রধারার মতন। কখনো কাছে আসে।কথা হয় নীচু স্বরে। তারপর হারিয়ে যায় শাল, সেগুনের গহন অরণ্যে, সংসারের চেনা চৌহদ্দিতে কিংবা জনঅরণ্যের বিস্তৃত পরিসরে। পারস্পরিক ভিন্নতাই তাদের অতীত, বর্তমান, হয়তো ভবিষ্যতও। ভিন্নতা মনের অবয়বে, ভিন্নতা শরীরের মাপজোখে, ভিন্নতা বয়সের বিন্যাসে। ভিন্নতা বাস্তবে, ভিন্নতা স্বপ্নে, ভিন্নতা মেধায়-মননে, ভিন্নতা বিত্তে-বৈভবে, ভিন্নতা রিক্তে। তবু যেন রীতিমতো গোলটেবিল বৈঠক করে, টেবিলের ওপর তিস্তার গতিপথের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমই শুধু নয়, ঈশান, মরুৎ সহ দশদিকের ওপরেই আতস কাঁচে গভীর নিরীক্ষণ সেরে, ভাগ বাঁটোয়ারা সারা হয়ে গিয়েছে সেই কবেই। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কালিতে নির্ণয় করে নিয়েছে উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত এবং উৎস থেকে মোহনার দিকে ধাবিত আস্ত একটি জীবনকে।
ভেবেছি, একী অক্ষমতা নাকি সক্ষমতা? একী অতৃপ্তি নাকি তৃপ্তির তুঙ্গে? একী অসম্পূর্ণতা নাকি সম্পূর্ণতারই ব্যাকরণ?
সেভকের করোনোশন ব্রিজের কাছে তিস্তা ছবি:শ্যামল মজুমদার
সে কোন তিস্তা, যে ছিলো আমার প্রথম প্রেম‌ ! ভালোলাগার প্রথম আবেশ,ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি, যৌনতার প্রথম পাঠ। ছুঁতে চাওয়ার আকুতি। সেকী ছিলো শুধুই বিস্তৃত জলধারা, বেগবান, খরস্রোতা। কখোনো নীল, কখোনো সবুজ, স্বপ্নে নীলাভ-সবুজ। আবার মেঘলা আকাশের নীচে যেন ঘোলাটে, জটিল বহমান এক আবর্ত। তিস্তা মানে কী শুধুই সেই জলধারা, ভোরের বাতাসে যার ছন্দে ভৈরবের সুর, মধ্যরাতে দরবারী কানাড়ার, কিংবা মন খারাপ করা কোনো বিকেলে বেহাগের বিষণ্ণতা কিংবা সন্ধ্যারাতে বাগেশ্রীর। তিস্তা মানে কী সেই সাদা নুড়ি বিছানো বিছানা নয়, নীলাভ সবুজ ধারাকে যা ফ্রেমবন্দী করে উজ্জ্বল সাদায় ? কিংবা শাল-সেগুন-শিশু-শিমুলের সেই অরণ্য যা কখনও আড়াল তোলে কালরাত্রির মতো, মিলনে উদগ্রীব দুটি প্রাণের মিলনের ইচ্ছাটুকু আরো খানিকটা জারিয়ে দিতে। যেমন পাতাগুলো চেটেপুটে নেয় প্রথম বর্ষার বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা, দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে। প্রথমে ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন, বিরামহীন সেই সম্ভোগ, খানিক সম্বিৎ ফিরলে উজ্জ্বল সবুজে যার আত্মপরিচয় প্রকাশ। তখন বেশ ঠাহর করা যায়, সবুজেরও সেই তারতম্য। শালের সবুজ আর জারুলের সবুজে ফারাক ঠিক কতখানি!
এই বোধই কী অনুভূতি? তা যদি না হয়, তবে আমাজনের অরণ্য আর মহানন্দার অরণ্যেই বা কী ফারাক? বিষ্ণুপুর, বান্দোয়ান, বাঘমুন্ডি আর ঝাড়গ্রামের শালের বনের সাথে কতটা ফারাক কালচিনি কিংবা কুমারগ্রামের শালবনের? সে কী শুধুই জ্যামিতিক মাপজোখেই বিচার্য? হৃদয়ের উষ্ণতায় তার বিচার চলে না? রঙের বাহার তবে তো নিছকই আতিশয্য। জল-জঙ্গল সেখানে প্রাণহীন, অর্থহীন এক ঘোষণা মাত্র। তিস্তা মানে কী সেই বন্যপ্রাণ কিংবা তিস্তাপারের সেই জনবসতি বা  সেই জনজীবনও নয়? কিংবা তিস্তার তটে কোনো কদম ছায়া আর বর্ষার কদমের গন্ধও? তা যদি না হতো, তবে কী তিস্তা রঙে-রূপে-বর্ণে-গন্ধে এক মূর্ত উপস্থিতি লাভ করতো? কখনও করতো? করতো কখনও?
সুন্দর না সুন্দরী? কীসে মোহিত আমি? সুন্দরীর লিঙ্গ সুনির্দিষ্ট, সুন্দর লিঙ্গের উর্ধ্বে। প্রখর মেধা-গ্রীষ্মের মতোই যার প্রখর দীপ্তি, তাকে পছন্দ বা অপছন্দ করা চলে, অস্বীকার করা যায় না। বর্ষার সজীব অভিমান-অবিরাম যা ঝরে ক্লান্তিহীন ভাবে, ভীষণ ভালোবেসে যাকে জড়িয়ে ধরা যায় কিংবা করা চলে নিতান্ত অস্বীকার, ঘ্যানঘ্যানে, প্যানপ্যানে-এই অছিলায়। শরতের নীল আকাশের ঔদার্য- যার কাছে অবলীলায় কবুল করা যায় নিজের গোপনতম অপরাধটিও। হেমন্তের স্নিগ্ধ মেদুরতা, আলো-আঁধারির সন্ধিক্ষণে যার অবস্থান-কিছু থাকে সোচ্চারে, খানিক অস্ফুটে। শীত- অস্থিত্ব জানান দেবে যে প্রতিটি পদে, তার বশ মানানো ব্যক্তিত্বে, তার কৃতিত্বে কিংবা নিভৃত নিরালার উষ্ণতায়। নাকি নেশা ধরানো অমলিন, অম্লান বসন্ত বাতাস-স্রেফ যার উপস্থিতিই বুনে চলে আবেশ আর উষ্ণতার এক নতুন জ্যামিতি, গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হয় যে মুগ্ধতার আবেশ, মনে আনে প্রশান্তি, ভালোলাগা আর ভালোবাসার এক বিশুদ্ধ অনুভূতি। কোনটাতে অধিকার? কোনটা ভালোবাসা? অনধিকারই বা কীসে? মন্দবাসাই বা কোনটি? আজ ফের নতুন করে পথ চলা শুরু হলে, মেঘের ডানায় ভর করে ফিরে চাইতাম কোনপানে? কোন অভিমুখে বইতো ধারা-উৎস থেকে মোহনায়?
ভালোবাসা-মন্দবাসার প্রথাগত ধারণা এখন অলীক। যেমন অর্থহীন গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্তের কাল্পনিক সীমারেখাও। ঘরে-বাইরের বিভেদ এখন অশালীন। ঘরে-বাইরের আড়াল ঘোচাবার জন্য একফালি পর্দাও এখন আতিশয্য, অনাবশ্যক। নগ্নতাই এখন বাস্তব। নগ্নতা স্বপ্নেও। নগ্নতা কোলাহলে।নগ্নতা নৈঃশব্দ্যে। নগ্নতা প্রেমে। নগ্নতা না-প্রেমেও।
এখন সোজা-সাপটা তাকাতে পারে তোমার চোখে, আমার চোখ।দুদিন আগেও যা আড়াল খুঁজতো। এখন সম্পূর্ণ নগ্নভাবে দাঁড়াতে পারি তোমার সামনে। দুদিন ‌আগেও যা ভেবে কান লাল হতো। এখন সম্পূর্ণ নগ্নভাবে অক্লেশে, অবলীলায় বলে যেতে পারি নিজের গোপনতম অপরাধের কথা। এখন অবলীলায় হাত বুলাতে পারি তোমার নগ্ন দেহে, দুদিন আগেও যা ছিলো কল্পনার অতীত। সম্পর্ক, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরের সব হিসাবই এখন অলীক। ছয় ঋতুর কোনোটির মুগ্ধতার আবেশেই এখন দিন কাটে না। বছরও ঘোরে না।জীবন মানে এখন মুহূর্তের জন্য বাঁচা। আবার অন্তহীন পথ চলাও। পরবর্তী মুহুর্তের প্রতীক্ষায়। গ্রীষ্মের মেধার প্রখর দীপ্তিতে এখন কাটি-ছিঁড়ি বর্ষাকে। আর বর্ষার সজীব আলিঙ্গনে নিঃশ্বাস ফেলি বসন্ত বাতাসের জন্য। আবার যখন বসন্ত আসে এই প্রাণেই, তৈরি হয় এক আবেশ, তখন ভাবি হেমন্তের নরম রোদে সেই ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তগুলোর কথাই। শীতের মধ্যেও খুঁজে ফিরি, বৈশাখের উষ্ণতাকে। চরিত্রগত ভাবে যার অবস্থান সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে, যেমন শীত আর গীষ্ম, সাদা আর কালো, আলো আর অন্ধকার।তবু সেই বৈপরীত্যেই খুঁজি সম্পূর্ণতা। যেমন গ্রীষ্মকে খানিক সহনীয় করে নিতেই কামনা করি বর্ষাকে। তেমনই গ্রীষ্মে শীতের কথা। শরৎ, হেমন্ত আর বসন্তের ব্যক্তিত্ব ভারী মিষ্টি, আদুরে। অনায়াস, স্বচ্ছন্দ বিচরণ চলে যার সীমানা অতিক্রম করেই। আর অজান্তেই তৈরি হয়ে যায় সম্পূর্ণতার এক নতুন সংজ্ঞা।
এ সংজ্ঞা দেবতার। কারণ, তিনি সর্বপূজ্যা। তাতে বাছ-বিচার নেই। এ সংজ্ঞা জননেতার। কারণ, গোপনীয়তায় মালিকানা নেই তারও। এ সংজ্ঞা সর্বভোগ্যার। কারণ, নগ্নতাই তার বাস্তবতা। এ সংজ্ঞা হা-ভাতেরও। কারণ, সে সর্বংসহা। জীবন যাকে পরিত্যাগ করেছে, বঞ্চনাই যার নিত্যসঙ্গী, কিন্তু স্বপ্নে যার আজও অধিকার। এ সংজ্ঞা হয়তো তেমন কারোরও, ভালোলাগা, ভালোবাসা আর যৌনতার প্রথম পা‌ঠ যে শিখেছিলো, কোনো নদীর কাছে, খোলা আকাশের নীচে। মূর্ত-বিমূর্তের ছক বাঁধা জীবনকে অস্বীকার করতেও। মূর্তে-বিমূর্তে, গ্রীষ্মের প্রখর দীপ্তিতে এবং বর্ষার ধারায়, শীতের উষ্ণতায় আবার প্রাণখোলা বসন্ত বাতাসে, শরতের ঔদার্যে কিংবা হেমন্তের পেলবতায়, সৌন্দর্যে কিংবা বীভৎসতায়, উৎস কিংবা মোহনায়, নগ্নতায় এবং আড়ালেও, ঋষির মগ্নতায় কিংবা শিশুর সারল্যের অলীক কল্পনার ধূসর সাম্রাজ্যে, নিষিদ্ধ শব্দের নাম তাই ‘ভালোবাসা’ আর না-প্রেমের নাম তিস্তা।

No comments:

Post a Comment