Monday, April 04, 2011

প্রকৃতির কোলের ঠিকানা লাটাগুড়ি আজ খুলে দিয়েছে আয়ের রুদ্ধ পথ

লাটাগুড়ির প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। ছবি: রবীন গোলদার
কৌশিক সরকার
মেঘলা দিনে শেষ বিকেলের বাতাস ভেজা। বৃষ্টি হয়েছে, কখনও টিপটিপ, কখনও ঝমঝম। তির তির করে বইছে মৃদু মন্দ বাতাস। ইঙ্গিত রয়েছে, রাতে ফের বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি ধোয়া জলে জঙ্গলের গাছগাছালিগুলো যেন এখন আরও সবুজ। তবু সব সবুজ যেন এক নয়। ফারাক বেশ মালুম হয়। হাত কয়েক দূরে বয়ে চলেছে ন্যাওড়া নদী। এখনও অলস, এখনও মন্থর। দূরের জঙ্গলে একে একে সন্ধ্যাদ্বীপের মতো জ্বলে উঠছে জোনাকি। এক নাগাড়ে ঝিঁঝির আওয়াজ। থেকে থেকে যেন ডেকে উঠছে কোনো বউ-কথা-কও। আর কাছে-দূরে গাছে গাছে কেকা। বেশ বোঝা যাচ্ছে, একটি নয়, দু’টি নয়, অন্তত ডজন খানেক ময়ূর রয়েছে ধারে পাশের গাছগুলিতেই। তারপর সন্ধ্যা নামলো। আর ...‘থাকে অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার।’



কলোখাওয়া ওয়াচ টাওয়ার। গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। ন্যাওড়া নদীর ধারে, জঙ্গলের অভ্যন্তরে সুসজ্জিত পর্যটক কটেজ। গোরুমারার সর্বশেষ সংযোজন। এখনও তেমন পরিচিত হয়নি পর্যটকদের কাছে। কিন্তু ডুয়ার্সের পর্যটন সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন গত ক’বছরে লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে নতুন ভাবে সাজানো হচ্ছে ডুয়ার্সের পর্যটনকে। গড়ে উঠেছে ৩৩টি নতুন পর্যটক আবাস। বেসরকারী উদ্যোগে। এখন একসাথে থাকতে পারেন প্রায় পাঁচশো পর্যটক। ৩৩টি পর্যটক আবাসের মধ্যে এগারোটিই স্থানীয় উদ্যোগপতিদের। এছাড়াও রয়েছেন জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, শিলিগুড়ি এবং কলকাতার উদ্যোগপতিরাও।
হাত বাড়ালেই গোরুমারা ছবি : সৌগত চ্যাটার্জী
ইকো-ট্যুরিজমকে (প্রকৃতি-পর্যটন) ভিত্তি করেই ডুয়ার্সের পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম গন্তব্য হিসাবে ইতোমধ্যেই উঠে এসেছে লাটাগুড়ি। বলছিলেন আশিস সরকার। লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে এই কর্মযজ্ঞের অন্যতম নেপথ্য কারিগর যে তিনিই, একথা স্বীকার করছেন হোটেল মালিক থেকে ভ্যান-রিকশা চালক কিংবা গাড়ির চালক। এর ফলে শুধু যে পর্যটকরাই উপকৃত হচ্ছেন তা নয়, এক অর্থনৈতিক বদ্ধদশা থেকেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে লাটাগুড়ি। মূলত এক দশকে। তবে প্রকৃতি পর্যটন মানে এখানে খানিক জঙ্গল, খানিক পর্যটনের মশালা মুভি নয়।

অরণ্য, টাস্কার্স ডেন-এর মতো ট্যুরিস্ট লজ মালিকদের অনেকেরই পুরানো ব্যবসা ছিল কাঠের। অরণ্য রিসর্টের মালিক শুভাশিস চ্যাটার্জি জানালেন, ১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ আইন চালুর ফলে অনেকটাই মার খায় লাটাগুড়ির কাঠের ব্যবসা। সে সময়ে লাটাগুড়িতে ছিল ১৫টি শ’মিল, একটি প্লাইউড মিল। এছাড়াও রেলের স্লিপার এবং বিদ্যুতের খুঁটিও সাপ্লাই যেতো লাটাগুড়ি থেকে। শ’মিল, প্লাইউড কারখানা সহ এই কাজগুলিতে যুক্ত ছিলেন প্রায় হাজার খানেক শ্রমিক। কাঠের ব্যবসা মার খাওয়ায় ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে মিলগুলি। কাজ হারান শ্রমিকরা। শুরু হয় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিন গোনা। সেই প্রেক্ষিতেই ফের মোড় ঘোরায় এই প্রকৃতি পর্যটন।
আয় এখন? অরণ্য, ময়ূর, লেক ভিউ, সোনার বাঙলা, পাশাখা, টাস্কার্স ডেন, গ্রিন ভিউ, সবুজ সাথী, বনানী, গ্রিন লেগুনের মতো রিসর্টগুলির মালিক লাটাগুড়ির উদ্যোগপতিরাই। এক সময় তাঁদের অনেকেই ছিলেন টিম্বার মার্চেন্ট। একে কেন্দ্র করে লাটাগুড়িতেই এখন স্থানীয় যুবকরা কিনেছেন প্রায় দেড়শো গাড়ি। বাপী চন্দ্র, বাপ্পা গাঙ্গুলি, নাকু গোপের মতো যুবকরা এখন পর্যটনকে কেন্দ্র করে গাড়ির ব্যবসা করেই সংসার চালাচ্ছেন। ধীরেন কোড়া, দুকু কোড়া, দুর্জন কোড়া, রাজেশ ওঁরাওদের মতো প্রায় ৭০ জন আদিবাসী যুবক এখন করছেন গাইডের কাজ। বিচাভাঙা বনবস্তি, সরস্বতী বনবস্তি, ধূপঝোড়া, রামসাইয়েই তাঁরা থাকেন। ট্যুরিস্ট গাইড ধীরেন কোড়াই জানালেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে বন দপ্তর। গাইডের ফি গাড়িপিছু একশো টাকা। আরও জানালেন, এ’কাজ করে এখন মাসে গড়পড়তা দেড় হাজার থেকে দু’হাজার টাকা আয় হচ্ছে তাঁদের। আগে বনের শুকনো কাঠ, রুল, ছত্রাক কুড়িয়ে বিক্রি করেই দিন গুজরান হতো তাঁদের। এছাড়া পর্যটনকে কেন্দ্র করেই নানা হস্তশিল্প সামগ্রীর দোকান, অন্যান্য দোকান বাজারেরও বিরাট সম্প্রসারণ ঘটেছে লাটাগুড়িতে, আগে যেখানে ছিল ভাঙা কাঠের গুটিকয়েক দোকান। এমনকী লাটাগুড়িতে ফরেস্ট ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারের টিকিট বিক্রি করে যা উপার্জন হয়, তারও ২৫ শতাংশ অর্থ ভাগ করে দেওয়া হয় বনবস্তিগুলির পরিবারগুলির মধ্যে। জানালেন বিচাভাঙা বনবস্তির ধীরেন কোড়া, যিনি এখন ট্যুরিস্ট গাইড। এখানকার ইকো ট্যুরিজম রেঞ্জের রেঞ্জার শম্ভু সূত্রধর জানালেন, গত বছর গুরুমারা জাতীয় উদ্যানে এসেছিলেন ৬৬ হাজার পর্যটক।

এছাড়াও লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে পর্যটন আকর্ষণ এবং ডুয়ার্সের লোক সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যেই গত কয়েক বছর ধরে লাটাগুড়িতে শুরু হয়েছে উত্তরবঙ্গ লোকসংস্কৃতি উৎসব ও ডুয়ার্স প্রকৃতি পর্যটন মেলা। লাটাগুড়িতে ওঁরাও, খেড়িয়া, ওড়িয়াদের লোকসংস্কৃতি ও লোকনৃত্য, পনঝোড়ার নেপালী লোকসংস্কৃতি এবং ধূপঝোড়ার ভাওয়াইয়া গান আর আদিবাসী নৃত্যের ব্যবস্থাও করা হয় পর্যটকদের জন্য।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, অরণ্যকে কেন্দ্র করে পর্যটনের এই প্রসারের ফলে কি ক্ষতি হচ্ছে জঙ্গলের? বিপন্ন হচ্ছে পশু পাখিরা? এ প্রশ্ন অবান্তর নয়। অলীক নয় এই আশঙ্কাও। কিন্তু সুখের কথা, গত বছর সারা দেশের মধ্যে সেরা জাতীয় উদ্যানের শিরোপা পেয়েছে এই গোরুমারা জাতীয় উদ্যানই। ওয়াইল্ড লাইফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইকনমিক রিহ্যাবিলিটেশন-এ ১০০-র মধ্যে ৮৬ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে ৯৮ বর্গ কিলোমিটারের গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। ১৯৭৭ সালে যেখানে এই অরণ্যে একশৃঙ্গ গঙ্গারের সংখ্যা কমে হয়েছিল ৭টি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬টিতে। বাইসন, সম্বর, চিতল হরিণ, হাতি, লেপার্ড সবই কমেছিল। এখন বাইসন হাজার দেড়েকের বেশি। হাতি ৪০টি। চিতল হরিণ, লেপার্ড, সম্বর সবই বেড়েছে যথেষ্ট। আর তা পর্যবেক্ষণের জন্য এখন গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার। আগে ছিল মাত্র একটি, গোরুমারায়। এখন তারই সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে যাত্রাপ্রসাদ, মেদলা, চুকচুকি, চন্দ্রচূড়, চাপড়ামারি, কলোখাওয়ার মতো টাওয়ারগুলি। আর লাটাগুড়ি ছাড়াও পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে ধূপমোড়া, বাতাবাড়ি, পানঝোড়া, রামসাই, কালীপুর বনবস্তি এবং বিচাভাঙা বনবস্তিতেও। আর, লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে দুই থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে চাপড়ামারি, শিবচু, বান্দাপানি, নাথুয়া, খুট্টিমারি, গোরুমারার মতো অরণ্যগুলি। খাদের কিনার থেকে আজ যে আবার প্রকৃতি পর্যটনকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে লাটাগুড়ি, একথা আজ মানছেন স্থানীয় সব মানুষই।

No comments:

Post a Comment