Wednesday, April 06, 2011

যেখানে সন্ধ্যা নামে সূর্য ডোবার অনেক আগেই


[জলপাইগুড়ির রাঙামাটি চা-বাগান।ছবি: শ্যামল মজুমদার]
কৌশিক সরকার

দেশটা যদি পুরানো হয়, তবে তার একটা ইতিহাস থাকবেই। নতুন হলেও থাকবে, পুরানো ইতিহাসের কোনো সূত্র।সে ইতিহাস বহুল চর্চিতই হোক বা আদৌ না-চর্চিত।তা আলোকেই থাক বা অন্ধকারে।হরপ্পা- মহেঞ্জোদারোর সময় থেকেও শুরু করে ব্রিটিশ শাসন  পর্যন্ত সময়কালকে যদি বিবেচনায় রাখা যায়, তবে ভারতের ইতিহাস কেবলমাত্র উত্তরভারত , উত্তর-পশ্চিম ভারত বা দাক্ষিণাত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। দীর্ঘ এই সময়কালে, বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী দেশের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব প্রান্তও। যদিও, সে ইতিহাস অনেকাংশেই আজও অবহেলিত।অথচ, স্থানীয় মানুষের মনে তার জায়গা, তাকে ঘিরে আবেগ, অনুভূতি কিন্তু আজও রয়েছে।
মহাকাব্যের বর্ণনায় কুরুক্ষেত্র প্রান্তর যা ছিলো এক যুগসন্ধিক্ষণের সাক্ষী, কিংবা পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, যা পরবর্তী প্রায় পাঁচশো বছরের জন্য ভারতে রচনা করেছিলো মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি, সে ইতিহাস আলোচিত। বস্তুত, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জয়ের পর ভারতে মোঘলদের দ্বারা নির্মিত প্রথম পরিকল্পিত নগর ফতেপুর সিক্রিও আজ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে এক অন্যতম গন্তব্য। সে কথা সুখের। কিন্তু, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি পরবর্তী প্রায় দুশো বছরের জন্য রচিত হলো যে প্রান্তরে, সেই পলাশী কিন্তু আজও নিঃসঙ্গ, একাকী।আবার স্বাধীনতার লড়াইয়েও দেশের প্রধান তিনটি স্থানের মধ্যে পাঞ্জাব আর মহারাষ্ট্রের সঙ্গে কিন্তু একইসঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলো বাংলাও। ইতিহাস মানে কেবল রাজা-রাজরার কাহিনীও নয়, যদিও এদেশে সংগঠিত ইতিহাস চর্চায় তাই পেয়ে এসেছে এক ভারসাম্যহীন গুরুত্ব।আর, তাই ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য বলতে যা বোঝায় , তাও তৈরী হয়েছে সেই চর্চিত ইতিহাসকে কেন্দ্র করেই, তাকে সংরক্ষণের মাধ্যমেই। মহাভারতের কথাই যদি ধরা যায়, চিত্রাঙ্গদাও তো মণিপুরের রাজনন্দিনী। সে কথা অনেকেরই অজানা। অনেকেই হয়তো জানেন না, বক্তিয়ার খিলজীর সমাধি আজকের দক্ষিণ দিনাজপুরে।আবার, মহাভারতের ট্র্যাজিক নায়ক কর্ণ-র নাম থেকেই উৎপত্তি কর্ণঝোড়া এবং করণদীঘির।যেমন একথাও কম আলোচিত যে একান্নপীঠের পাঁচটি পীঠই বীরভূমে। অনেকেই হয়তো জানেন না, উত্তরবঙ্গের তিন জেলা, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার আর দার্জিলিঙেই রয়েছে অন্তত আট-আটটি জাতীয় উদ্যান কিংবা অভয়ারণ্য।রয়েছে এমন আরো বহু নিদর্শনও।
কাঞ্চনজঙ্ঘায় ভোরের রাগ ছবি: সৌগত চ্যাটার্জী

এও যেন অর্থনীতির ‘দারিদ্রের দুষ্টচক্র ’ –র মতোই। সংগঠিত ইতিহাস চর্চা নেই তাই সেই সংরক্ষণের দায়। সংরক্ষণ নেই তাই নেই পর্যটন আকর্ষণ। আকর্ষণ নেই তাই নেই চর্চাও।অথচ কী নেই পশ্চিমবঙ্গে? না, মরূভূমি নেই। মরুদ্যান ? সে প্রসঙ্গ থাক।আছে , বিরল ম্যানগ্রোভ অরণ্য, আছে নদী-নালা ঘেরা সুন্দরবন, আছে সমুদ্র, আছে ব্রিটিশ শাসনের স্মারক, স্থাপত্য, ভাস্কর্য; আছে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসও, আছে ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণের ইতিহাসও। ইতিহাসের গতিপথের পথ পরিবর্তন উদ্দেশ্য নয়, নয় তার নির্বাচিত গৌরবময় অধ্যায়ের চর্চাও, উদ্দেশ্য তার প্রকৃতি, পরিবেশ, ইতিহাসের চর্চাই, যে ইতিহাস রাজা-রাজরারও, আবার অতি সাধারণ কোনো জনজাতির, যে জীবনচর্চাতেই রয়েছে অসাধারণ সব টুকরো টুকরো ছবির এক কোলাজ। এরাজ্যেই আছে গৌড়, পুন্ড্রবর্ধন সহ কোচবিহার রাজবাড়ি কিংবা বৈকুন্ঠপুর এস্টেটের ইতিহাস। রয়েছে, গুপ্তযুগের সময়কালের নিদর্শন সহ পাল, হুসেন শাহী সময়কালের নিদর্শন, পুরাকীর্তি। বস্তুত, ১৫১০ খৃষ্টাব্দ থেকে কোচবিহার রাজবংশের সুষ্পস্ট ইতিহাস পাওয়া যায়।আর অতীতের বৈকুন্ঠপুর, যা আজকের জলপাইগুড়ি,সেই এস্টেট তৈরি হয়েছিলো ১৫৪৫ খৃষ্টাব্দে। তবে পশ্চিমে গৌড়,উত্তরে নেপাল,ভূটান এবং পূর্বে আসাম প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সাবেক সীমানা ঠেলাঠেলি করে কখনও বড়, কখনও ছোটো, আবার কখনও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে হতে স্বাধীনতার সময়কার কোচবিহার রাজ্যে এসে ঠেকেছিলো।তারমানে ভারতে মোঘল শাসনের সূত্রপাতের আগে থেকেই মিলছে কোচবিহারের রাজবংশের সুস্পষ্ট ইতিহাস। আর বৈকুন্ঠপুর এস্টেট যখন তৈরি হচ্ছে, ততদিনে চৌসা আর বক্সারের যুদ্ধে শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে মোঘল সম্রাট হুমায়ুন প্রমাদ গুনছেন।অন্যদিকে আজকের মালদহ জেলার ইতিহাসও পুরানো।প্রাচীন রাজধানী গৌড় থেকে কর্ণসুবর্ণ, লক্ষণাবতী হয়ে ফের গৌড়ের পুননির্মাণের মধ্যেই রয়েছে পুন্ড্রবর্ধন,শশাঙ্ক,গুপ্ত,পাল,সেন,হুসেন শাহী সুলতানী সাম্রাজ্য হয়ে মাৎস্যন্যায়ের ইতিহাস। যে ইতিহাসের পথ বেয়েই আজকের মালদহ, দিনাজপুরের জন্ম।মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু অংশেও মেলে সেই ঐতিহাসিক নিদর্শন।
আপন খেয়ালে ছবি:সৌগত চ্যাটার্জী

এরাজ্যেই আছে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের বেলুড়,শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ, রামমোহন-বিদ্যাসাগর সহ সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অসংখ্য নিদর্শন।আছে তাম্রলিপ্তর ইতিহাস এমনকী বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারকালের নিদর্শনও।আছে, দেড়শো বছর আগে স্থাপিত ব্রিটিশ মালিকদের দ্বারা স্থাপিত চা-বাগানের ইতিহাস, ‌আছে দেড়শো বছর আগেই ছোটোনাগপুর, মধ্যপ্রদেশের মতো এলাকাগুলি থেকে ছিন্নমূল হওয়া আদিবাসীদের ইতিহাসও। এক জলপাইগুড়ি জেলাতেই রয়েছে, এমন ছাব্বিশটি জনজাতির অস্থিত্ব। যা নিছক কম পাওয়া নয়। এদের মধ্যে যেমন অস্ট্রিক শাখার জনজাতিরাও রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন মোঙ্গলয়েড জনজাতির বাসও, যাদের একটি বড় অংশের জীবন আজও আবর্তিত হয় জঙ্গলকে কেন্দ্র করেই। তাই রয়েছে গহন অরণ্যও- বক্সা, চিলাপাতা, জলদাপাড়া, গোরুমারা, চাপড়ামারি, মহানন্দা, শিঙ্গালিলা ,নেওড়া ভ্যালী। আবার, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলেও রয়েছে এমন অরণ্য।রয়েছেন,আদিবাসী মানুষেরাও।
মূর্তি নদী ছবি: সৌগত চ্যাটার্জী

তিস্তা, তোর্ষা, জলঢাকা, রায়ডাক, সঙ্কোশ, মহানন্দা, কালজানি, ডায়নার মতো নদী আর বক্সা, চিলাপাতা কিংবা চাপড়ামারির মতো অরণ্য; জল-জঙ্গলে যেন প্রতিনিয়ত রচনা করে চলেছে অপূর্ব, নৈসর্গিক সব চিত্রকল্প। চিলাপাতার মতো অরণ্য, তোর্ষার ধারে যার ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায়, একদিকে বক্সা, অন্যপ্রান্তে জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। আবার বক্সা পাহাড় থেকেই পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় ভূটানের রূপম ভ্যালী। ঠিক যেমন কোচবিহার, হাসিমারা কিংবা আলিপুরদুয়ার থেকে সড়ক বা রেলপথে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছানো যায়, আসাম কিংবা ভূটানেও। কিংবা নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে পৌঁছানো যায় পার্শ্ববর্তী সিকিম, নেপাল কিংবা বিহারেও। আবার নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া থেকে মাল, মেটেলি,ওদলাবাড়ি, বানারহাট, নাগ্রাকাটা, মাদারিহাট, কালচিনি, ‌আলিপুরদুয়ার, কুমারগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে অসংখ্য চা-বাগান। যেমন রয়েছে কার্শিয়াং, কালিম্পং, দার্জিলিঙের পাহাড়েও। উত্তরবঙ্গ তাই হতেই পারে পর্যটকদের স্বাভাবিক পছন্দ।
ক্রীড়া এবং পর্যটনের মধ্যেও একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। উভয়ের মধ্যেই সঙ্কীর্ণতার স্থান কম। উভয়েই ভাঙে ভেদের বেড়া। যে মানুষ মিশরের নীল নদ কিংবা পিরামিড উপভোগ করেন, তিনি সমান আগ্রহেই দেখেন আমাজনের অরণ্য। কিংবা যিনি তাজমহল দেখেন, তিনিই দেখেন গ্রান্ড ক্যানিয়ন। যিনি, কেরালার কোভালম সমুদ্র উপভোগ করেন, তিনিই সমান উপভোগ করতে পারেন জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। আবার, পর্যটকের মানসিকতাও একইরকম নাই হতে পারে। কারো পছন্দ সমুদ্র, তো কেউ পছন্দ করেন পাহাড়। আবার কারো পছন্দের তালিকায় অরণ্য। যিনি অরণ্য পছন্দ করেন, তার আকর্ষণ খানিক কম থাকতেই পারে ইতিহাসে, কিংবা ধর্মীয় স্থানে।তাই বৈচিত্র যেখানে বেশী, পর্যটনের সম্ভাবনা সেখানে ততই উজ্জ্বল। এই বৈচিত্র আছে এরাজ্যে, তার এক আকর্ষণীয় পসরা সাজানো আছে উত্তরবঙ্গে।

বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প ছবি : অমিত কর

বাস্তবতা হলো, সেই সম্ভাবনার অনেকটাই আজও বিকশিত হয়নি। আবার একথাও সমান সত্যি, বিগত বছরগুলিতে তা থেমে নেই একই স্থানে।এগিয়েছে, নিশ্চিতভাবেই এগিয়েছে। তার সাক্ষী তথ্য, পরিসংখ্যান, তার সাক্ষী অভিজ্ঞতাও। কিন্তু সমস্যা হলো, তার যথাযথ বিপণন, প্রচারের যেমন ঘাটতি আছে, তেমনই ঘাটতি রয়েছে পর্যটকদের প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি যথাযথ ভাবে উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও।তাই এমন অভিজ্ঞতাও বিরল নয়, যেখানে নিছক অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা। বলাই বাহুল্য, সে অভিজ্ঞতা সবসময়ে সুখের নয়। পরিণামে, যা হতে পারতো জীবনের এক বড় পাওনা, তাও কখোনো সখনও হয়ে দাঁড়ায় এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। এখনও নিশ্চিতভাবেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণের, এবং সে কাজ মূলত সরকারেরই। তারসঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারী সংস্থাগুলিও পালন করতে পারে তাদের ভূমিকা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কারণ, তা না করা গেলে সাধ আর সাধ্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া ছাড়া বিশেষ করণীয় কিছু থাকে না।
তবু, যে পথ পার হওয়া গেলো তাও কম কিছু নয়। আজও সেখানে কোথাও কোথাও সন্ধ্যা নামে সূর্য ডোবার অনেক আগে‌ই। দূর পাহাড়ে জ্বলে ওঠে ওঠে সারি সারি আলো। পাহাড় সাজে যেন দীপমালায়। একদিন নয়, প্রতিদিন.






No comments:

Post a Comment