Tuesday, April 12, 2011

সবুজ অরণ্য, হলুদ স্মৃতি


গোরুমারার পথে ছবি:সৌগত চ্যাটার্জী
 কৌশিক সরকার
চির সবুজের দেশ জলপাইগুড়ি।অরণ্য এখানে আদিম, এখনও অনেকাংশেই অকৃত্রিম।বৈচিত্র তার পরতে পরতে।বীরভূমের প্রকৃতি বর্ণনায় প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন, ‘ইহার এক দিকে প্রান্তর, অন্য দিকে বন; এক দিকে নগ্নতা, অন্য দিকে আচ্ছাদন; এক দিকে নিঃস্বতা, অন্য দিকে সম্পদ। ইহার পশ্চিমে শাল পিয়াল মহুয়া, পূর্বে আম জাম কাঁঠাল; পশ্চিমে তাল, পূর্বে খেজুর; পশ্চিমে অর্জুন, পূর্বে বাঁশ। ইহার এক দিকে সন্ন্যাস, অন্য দিকে গার্হস্থ্য ; এক দিকে ঘরছাড়া বনস্পতির দল, আর-এক দিকে ঘর ঘেঁষা উদ্ভিদের শ্রেণী। ইহার মাঝখানে দাঁড়াইলে দেখিবে পূর্ব দিগন্ত পর্যন্ত একটানা ধান্যশীর্ষের স্নিগ্ধ শ্যামলতা আর পশ্চিমে সূর্যাস্তের সীমা পর্যন্ত রক্ত মাটির বিবর্ণ ধূসরতা। এক দিকে কঠোর দৃঢ়-পিনব্ধ নিশ্চপল স্তব্ধতা; অন্য দিকে শ্যামলে কোমলে উর্বরে বৈদগ্ধ্যে নর্মলীলা। এক দিকে তপঃসংযত বিশ্বামিত্র, আর-এক দিকে সেই তপ ভাঙাইবার জন্য মেনকা; ইহার পূর্বচক্রবালে বনলেখাবগুন্ঠনের নীলিমা, আর পশ্চিম প্রান্তর হা-হা শব্দে বিরাট বৈরাগ্যে ধ্বনিত হইয়া বনরেখাহীন অসীম শূন্যতার মধ্যে মিলিয়া গিয়াছে।’ বস্তুত, জলাপাইগুড়ির রূপ প্রকৃতিতেও মেলে এই বৈপরীত্য, যার অপার বৈচিত্র্যময় সম্ভার লুকিয়ে রয়েছে জেলার আনাচে-কানাচে।
দাঁতাল ছবি: রবীন গোলদার
এই স্থান দেখেই এক সময় (১৭৭৫ সাল) ভূটানে ব্রিটিশের প্রতিনিধি জর্জ বোগলে মন্তব্য করেছিলেন, দুর্গম অসাস্থ্যকর এই এলাকা জয়ের কোনো দরকার নেই।এখানে লাভজনক কিছু করা যাবে না। অথচ, ১৮৩১ সালে হজসন রিপোর্ট দিলেন,ডুয়ার্সে চা-চাষ দারুণ লাভজনক হবে। ১৮৩৯ সালে পেমবার্টন বললেন, ডুয়ার্সে পৃথিবীর সেরা চা উৎপাদন সম্ভব। তার পরের ইতিহাস অনেকটাই জানা।১৮৭৪ সালে গজলডোবা টি এস্টেট চালুর মধ্যে দিয়ে যে পথ চলার শুরু, আজ জেলার অন্যতম পরিচয়ই হয়ে উঠেছে সেই চা-ই। অন্যতম আয়ের পথও। শুধু জলপাইগুড়িই নয়, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং এবং উত্তর দিনাজপুর জেলারও বিশেষত ইসলামপুর মহকুমা জুড়ে তার বিস্তৃতি।এক সময়, যে এলাকাকে চিহ্ণিত করা হয়েছিলো, পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর কলকাতা এবং বর্ধমানের কয়লা খনি এলাকা ছাড়া এই বাংলার যে এলাকায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুঁজি সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছিলো, তা হলো পাহাড়, তরাই এবং ডুয়ার্সের চা-বাগান এলাকা।

কুলীকের পরিযায়ী শামুকখোল ছবি: অমিত কর
বৈচিত্র্য এখানের ভূ-প্রকৃতিতে।বৈচিত্র্য এখানে জনজাতির চরিত্রে।বৈচিত্র্য এখানের ভাষায়, বৈচিত্র্য ধর্মে। বৈচিত্র্য আয়ের উৎসে, বৈচিত্র্য জীবন চর্চায়।এক জলপাইগুড়ি জেলাতেই রয়েছে প্রায় প্রতিটি ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ। অথচ, জনসংখ্যার তুলনায় এই জেলায় পুরানো ধর্মীয় স্থানের সংখ্যা নিছকই হাতে গোনা। এই জেলাতেই রয়েছে অন্তত ২৬ রকম জনজাতির বাস। তাদের ব্যবহৃত ভাষা-উপভাষার সংখ্যা ১৫১ টি, যার মধ্যে ৮ টি বহিরাগত ভাষা, ৪২ টির এখনও বর্গীকরণ হয়নিজলপাইগুড়ি, কোচবিহার আর দার্জিলিং জেলায় রয়েছে আটটি জাতীয় উদ্যান কিংবা অভয়ারণ্য। এছাড়াও উত্তর দিনাজপুরে রয়েছে কুলীক পক্ষী নিবাস।
উত্তর সীমান্ত বরাবর সিঞ্চুলা পাহাড় আর পূবে আসামের মানস জাতীয় উদ্যান। মধ্যবর্তী প্রায় ৭৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জলপাইগুড়ির বক্সা জাতীয় উদ্যান।উত্তর প্রান্তে ভূটানের ফিপসু অভয়ারণ্যে মিশছে বক্সা, যা হাতিদের আন্তর্জাতিক করিডর। বক্সার দক্ষিণ-পশ্চিমে চিলাপাতার জঙ্গল, যে জঙ্গল পেরিয়ে হাতির পাল পৌঁছায় জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে।জলদাপাড়া, চিলাপাতা এবং বক্সা, জলপাইগুড়ির আলিপুরদুয়ার মহকুমারই অন্তর্গত। মহকুমা সদর আলিপুরদুয়ার থেকে বক্সার অন্যতম প্রবেশদ্বার রাজাভাতখাওয়ার দুরত্ব ১৫ কিলোমিটার আর চিলাপাতা ২০ কিলোমিটার। চিলাপাতা থেকে হাসিমারার দুরত্ব খুবই কম, আর সেখান থেকেই মাদারিহাট হয়ে পৌঁছানো যায় জলদাপাড়ার গভীর জঙ্গলে। জলদাপাড়া থেকে গোরুমারার দুরত্ব ৬২ কিলোমিটার। তার হাতের নাগালেই রয়েছে চাপড়ামারি অভয়ারণ্য।  আবার শিলিগুড়ির সুকনা থেকেই শুরু হচ্ছে মহানন্দা অভয়ারণ্য। শিলিগুড়ি থেকে তিস্তার পার ধরে গ্যাংটকগামী রাস্তা দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় কালীঝোড়া, রংপো।বাংলা-সিকিম সীমান্তের রংপোতেই তিস্তার সঙ্গে মিশেছে রঙ্গিত। আর দার্জিলিঙ জেলারই দার্জিলিঙ মহকুমায় রয়েছে সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান এবং কালীম্পং মহকুমায় ন্যাওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যান।
মূর্তি নদীর ধারে পর্যটক আবাস ছবি: শ্যামল মজুমদার
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকার মধ্যেই রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। আলিপুরদুয়ারকে কেন্দ্র করেই যেগুলিতে পৌঁছানো সুবিধাজনক।জয়ন্তী (৩০ কিলোমিটার), বড়ডাবরি (২৫ কিলোমিটার), নিলপাড়া ( ২৭ কিলোমিটার), চিলাপাতা ( ২০ কিলোমিটার), কোদালবস্তি (২২ কিলোমিটার), বাংলা-আসাম সীমান্তে বারবিশা শিলবাংলো ( ৪৫ কিলোমিটার), বাংলা-ভূটান-আসাম সীমান্তে কুমারগ্রাম ( ৬৫ কিলোমিটার), রায়মাটাং (৪৫ কিলোমিটার), নিমাতি (১৭ কিলোমিটার), রাজাভাতখাওয়া (১৫ কিলোমিটার),সান্ত্রাবাড়ি,বক্সাদুয়ার আলিপুরদুয়ার থেকেই কুমারগ্রামগামী রাস্তায় কামাক্ষ্যাগুড়ি হয়ে যাওয়া যায় তুফানগঞ্জের আটিয়ামোচড়, যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে রসিকবিল। বিশেষ করে পরিযায়ী পাখীর জন্য পরিচিত এই রসিকবিল।কোচবিহার থেকেও যাওয়া যায় সেখানে।

চারখোল থেকে চুইখিমের পথে ছবি: সৌগত চ্যাটার্জী
তবে বড়ডাবরি, চিলাপাতা, কোদালবস্তি হাসিমারা থেকেও যাওয়াও সুবিধাজনকজলপাইগুড়ি থেকে হাসিমারার দুরত্ব ৭৫ কিলোমিটার আর আলিপুর দুয়ার থেকে হাসিমারার দুরত্ব ২৫ কিলোমিটার।হাসিমারা থেকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছানো যায়, বাংলা-ভূটান সীমান্ত জয়গাঁ।সেখানেই রয়েছে ভূটানের প্রবেশদ্বার। ওপারেই ভূটানের সীমান্ত শহর ফুন্টশেলিং।সেখান থেকে রাস্তা গেছে ভূটানের পাহাড়ি শহর ও পুরানো রাজধানী পারো এবং বর্তমান রাজধানী থিম্পু।
অন্যদিকে,জেলা সদর অন্যদিকে,জলপাইগুড়ি থেকে গোরুমারার দুরত্ব ৫০ কিলোমিটার আর চাপড়ামারির দুরত্ব ৬৫ কিলোমিটার।গোরুমারার অদূরেই গড়ে উঠেছে লাটাগুড়ি প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। তার দুই থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে চাপড়ামারি, শিবচু, বান্দাপানি, নাথুয়া, খুট্টিমারি এবং গোরুমারা।আবার, লাটাগুড়ি অথবা মহকুমা সদর মালবাজারের থেকেও স্বল্প দুরত্বে রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। মালবাজার, চালসা, মূর্তি,চাপড়ামারি, গোরুমারা, সামসিঙ, সুনতালেখোলা, ঝালং, বিন্দু, গেহনবাড়ি এমনকি গরুবাথান পাহাড় হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ। সামসিঙ থেকে ন্যাওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানও কাছেই।আবার মালবাজার থেকেই সেবক রোড হয়ে চলে যাওয়া যায় শিলিগুড়িও।জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার মাদারীহাট, আর মাদারীহাট থেকে ৭ কিলোমিটার ভিতরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের হলং বাংলো। মাদারীহাট থেকে কাছেই খয়েরবাড়ি।আর মাদারীহাট থেকে টোটোপাড়ার দুরত্বও ২২ কিলোমিটার। জলপাইগুড়ি থেকে যাওয়া যায় ময়নাগুড়ির কাছে জল্পেশ ,আমবাড়ি, শিকারপুর জঙ্গলের কাছে বোদাগঞ্জেও।

অর্কিড ছবি:সৌগত চ্যাটার্জী
দার্জিলিঙ জেলাতেও কার্শিয়াঙ, কালিম্পং এবং দার্জিলিঙ ছাড়াও রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র। মিরিক,লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ তো রয়েছেই।আছে লেপচাজগৎ, রিম্বিক, মংপঙ, রোহিনী, রাম্মাম,মংপু, শ্রীখোলা, পালমাজুয়ার মতো কেন্দ্রগুলিও।এছাড়াও গড়ে উঠেছে তিনচুলে, চুইখিমের মতো কেন্দ্রগুলিও।
অপাপবিদ্ধ  ছবি: সৌগত চ্যাটার্জী
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প, যা জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পেয়েছে ১৯৯৭ সালে, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর এক বিরাট বৈচিত্র্যময় সম্ভার রয়েছে তাতে।এখানে রয়েছে ১০৮ প্রজাতির লতা, ১৩৩ প্রজাতির গুল্ম, ৩৫২ প্রজাতির বৃক্ষ,১৪৪ প্রজাতির অর্কিড,১১২ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদজলজ উদ্ভিদই রয়েছে ১৩০ প্রজাতির, একবীজপত্রী এবং ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে প্রায় ১৬০ টি প্রজাতির।বাঁশই মেলে দশটি প্রজাতির, বেত নটি প্রজাতির।শাল, সেগুন, চাপ, গামার, শিমুল, চিকরাশি-র বিপুল সম্ভার এখানে।শুধু পাখীই রয়েছে ২৪৬ প্রজাতির, স্তন্যপায়ী ৬৮ প্রজাতির, সরীসৃপ ৪১ প্রজাতির,মাছ ৩৬ প্রজাতির।রয়েছে রং-বেরঙের প্রজাপতি।(সূত্রঃ রাজাভাতখাওয়া প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র)বক্সায় মেলে শাদা-পীঠ শকুন, জংলী মুরগী, নীল পায়রা, গোলাপী-বুক টিয়া, লং টেইলড নাইটজার, নীল মাছরাঙা, স্মল গ্রীন বি-ইটার, বড় বসন্ত, কসাই পাখী, ভীমরাজ,ফিঙে, হেয়ার ক্রেসটেড ড্রোংগো, ঝুটি শালিখ, জাঙ্গল ময়না,হাঁড়িচাচা, দাঁড়কাক,ছাতারে, গ্রে বুলবুল, রেড ভেন্টেড বুলবুল, হলদে পেট চাকদোয়েল, নীল কটকটিয়া, সাদা কালো চুটকি,কস্তুরা, সাদা খঞ্জন,ঘুঘু সহ নাম জানা ও না-জানা বহু পাখী।রয়েছে চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন, অ্যান্টিলোপ, রিগাল পাইথন,অসংখ্য ময়ূর,সজারু, বাঁদর,শুয়োর,হরিণ,বন বিড়াল, চিতাবাঘ এবং বাঘও।বক্সা আর চিলাপাতা জঙ্গলে এখনও এমন বহু এলাকা রয়েছে যেখানে আজও মাটিতে পৌঁছায় না সূর্যের আলো।হাতি, বাইসন, হরিণ, ময়ূরসহ জীব বৈচিত্র্যের ভালো সম্ভার রয়েছে চিলাপাতাতেও। এখানে রয়েছে এক ধরণের বৃক্ষ, যাতে আঁচড় কাটলে রস গড়ায় তাজা রক্তের মতো।নল রাজার গড়ের আশেপাশে রয়েছে এই প্রজাতির গাছগুলো। জলদাপাড়া অভয়ারণ্য বিখ্যাত তার এক শৃঙ্গ গন্ডারের জন্য। আসামের কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের পরেই ভারতে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক এক শৃঙ্গ গন্ডার মেলে এই জলদাপাড়াতেই। ১৪১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট এই অভয়ারণ্যজলদাপাড়া থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। ৯৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই গোরুমারাতেই রয়েছে ১৯৩ প্রজাতির পাখী,২২ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৭ প্রজাতির মাছ।জলদাপাড়ায় রয়েছে ৮টি প্রজাতির এবং গোরুমারায় রয়েছে ৭টি প্রজাতির কচ্ছপ।গত বছর সারা দেশের মধ্যে সেরা জাতীয় উদ্যানের শিরোপা পেয়েছে এই গোরুমারা জাতীয় উদ্যানইওয়াইল্ড লাইফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইকনমিক রিহ্যাবিলিটেশন-এ ১০০-র মধ্যে ৮৬ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে ৯৮ বর্গ কিলোমিটারের গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। ১৯৭৭ সালে যেখানে এই অরণ্যে একশৃঙ্গ গঙ্গারের সংখ্যা কমে হয়েছিল ৭টি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬টিতে। বাইসন, সম্বর, চিতল হরিণ, হাতি, লেপার্ড সবই কমেছিল। এখন বাইসন হাজার দেড়েকের বেশি। হাতি ৪০টি। চিতল হরিণ, লেপার্ড, সম্বর সবই বেড়েছে যথেষ্ট। আর তা পর্যবেক্ষণের জন্য এখন গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার। আগে ছিল মাত্র একটি, গোরুমারায়। এখন তারই সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে যাত্রাপ্রসাদ, মেদলা, চুকচুকি, চন্দ্রচূড়, চাপড়ামারি, কলোখাওয়ার মতো টাওয়ারগুলি। এর মধ্যে চুকচুকি ওয়াচ টাওয়ারটি গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষত পাখী পর্যবেক্ষণের জন্য। লাটাগুড়ি ছাড়াও পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে ধূপঝোড়া (লাটাগুড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার), বাতাবাড়ি (১২ কিলোমিটার), পানঝোড়া (৪৫ কিলোমিটার), রামসাই (২১ কিলোমিটার), কালীপুর বনবস্তি (১৮ কিলোমিটার) এবং বিচাভাঙা বনবস্তিতেও (২ কিলোমিটার)আর, লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে দুই থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে চাপড়ামারি (৪০ কিলোমিটার ভায়া মূর্তি), শিবচু (৩০-৩৫ কিলোমিটার), বান্দাপানি (৪০-৪৫ কিলোমিটার), নাথুয়া (৪০-৪৫ কিলোমিটার, যদিও হাতিরা যে পথে যায় তাতে দুরত্ব ৮-৯ কিলোমিটার), খুট্টিমারি (৩৫ কিলোমিটার), গোরুমারার (রাইনো টাওয়ার ১৩ কিলোমিটার)মতো অরণ্যগুলি।গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের কাছেই এবং চালসা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে চাপড়ামারি অভয়ারণ্য। বিশেষত হাতি, বাইসন, ময়ূর, হরিণ এবং বহু রকমের পাখীর দেখা মেলে চাপড়ামারিতে।বন বাংলো থেকেই ভোরবেলা এবং সন্ধ্যায় দেখা মেলে বন্যপ্রাণীর।
শিলিগুড়ি থেকে আধ ঘন্টার দুরত্বেই মহানন্দা অভয়ারণ্য। সুকনা থেকেই শুরু হচ্ছে ১৫৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট এই অভয়ারণ্য।উচ্চতম এলাকা লাতপানচার।উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার ফুট।শিলিগুড়ি থেকে তার দুরত্ব ৪৪ কিলোমিটার আর শিলিগুড়ি-গ্যাংটকগামী সড়কে কালীঝোড়া বাংলো থেকে তার দুরত্ব ১৩ কিলোমিটার।কালীম্পং মহকুমার নেওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যানের শিরোপা লাভ করে ১৯৮৬ সালেই। ৮৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই জাতীয় উদ্যানের উচ্চতম এলাকা রাচেলা ডান্ডা।উচ্চতা ১০ হাজার ৬০০ ফুট।সিকিম এবং ভূটান সীমান্তের এই জাতীয় উদ্যানটি পরিচিত ওক,ফার্ন,অর্কিড এবং রোডোডেনড্রনের জন্য। যেমন মহানন্দা অভয়ারণ্যে রয়েছে খয়ের এবং শিশুর বিপুল সম্ভার।বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী রেড পান্ডা ছাড়াও এখানে মেলে ক্লাউডেড লেপার্ড, মাস্ক ডিয়ারের মতো প্রাণী এবং কিং কোবরা, গ্রিন পিট ভাইপার, ব্লাইন্ড স্নেকও। কালিম্পং এবং লাভা থেকেই যাওয়া যায় এখানে। আবার চালসা, সামসিং থেকেও আসা যায় নেওড়া ভ্যালী অরণ্যে। নেওড়া নদীর উপত্যকা বলেই এর নাম নেওড়া ভ্যালী, যে নদী এলাকার জলেরও অন্যতম উৎস। কালিম্পং মহকুমার নেওড়া ভ্যালী ছাড়াও পাহাড়ের দার্জিলিং মহকুমাতে রয়েছে সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান। ৭৮.৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এবং প্রায় ৭ হাজার ফুট উচ্চতায় এই সিঙ্গালীলা ১৯৮৬ সালে অভয়ারণ্য হিসাবে এবং ১৯৯২সালে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পায়।এর মধ্যে দিয়েই বইছে রাম্মাম এবং সিরিখোলা (শ্রীখোলা) নদী।বাঁশ, ওক, ম্যাগনোলিয়া,রোডোডেনড্রন আর হরেক প্রজাতির অর্কিডের জন্য বিখ্যাত সিঙ্গালীলা।উত্তরে সিকিম এবং পশ্চিমে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই অরণ্য।মানেভঞ্জন থেকে সানদাকফু( ৩৬৩৬ মিটার) এবং ফালুট (৩৫৩৬ মিটার)পর্যন্ত ট্রেকিং রুটের জন্য পরিচিত এই সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান। উচ্চতম স্থান ১১ হাজার ৯১০ ফুট।রেড পান্ডা ছাড়াও হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার, লেপার্ড, ক্লাউডেড লেপার্ড, ওয়াইল্ড বোর, প্যাঙ্গোলিনের মতো প্রাণীগুলির জন্য পরিচিত এই অরণ্য।বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী রেড পান্ডার সংরক্ষণের জন্য ভারতে মোট ২০ টি স্থানকে নির্বাচিত করা হয়েছে, যার মধ্যে সিকিমের কাঞ্চনজঙ্ঘা জাতীয় উদ্যান, অরুণাচল প্রদেশের নামডাফা জাতীয় উদ্যান ছাড়াও রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান।সানদাকফুকে বলা হয়, ‘বিষাক্ত উদ্ভিদের পাহাড়’।মূলত, সানদাকফুর কাছে হিমালয়ান কোবরা লিলি-র আধিক্যের জন্যই তা বলা হয়।মার্চ-এপ্রিল এবং বর্ষার পরে অক্টোবর মাস নাগাদ রোডোডেনড্রন, ম্যাগনোলিয়া আর অর্কিডের ফুলে ছেয়ে যায় পাহাড়ী উপত্যকা।অন্যদিকে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের কাছে কুলীক নদীর ধারে কুলীক পক্ষী নিবাস পরিচিত প্রধানত পরিযায়ী পাখীর জন্য। বিশেষ করে অরণ্য জুড়ে যখন শামুকখোল পাখী বসে, মনে হয় সাদা সাদা থোকা থোকা ফুল ফুটেছে গাছগুলিতে।
জয়ন্তী ছবি: অমিত কর

বক্সা মানে শুধুই গা ছমছমে অরণ্য নয়। প্রকৃতি আর ইতিহাস এখানে যুক্ত অঙ্গাঙ্গীভাবে। জয়ন্তী থেকে পাহাড়ী ঝোড়া, কয়লা,গন্ধকের পাহাড় আর ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পৌঁছানো যায় মহাকাল।পাহাড়ের চূড়ায় মহাকাল মন্দির।আর চুনা পাথরের তিনটি প্রাকৃতিক গুহা।অন্ধকার সেই গুহায় হাজার হাজার বছর ধরে চুন আর জলের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাকমাইটের প্রস্তরীভূত সব মূর্তি। মোমের আলোয় সে গুহামূর্তি দেখা সত্যিই রোমাঞ্চকর।জয়ন্তী থেকে লেপচাখা হয়ে যাওয়া যায় বক্সা পাহাড়ে। অথবা সান্ত্রাবাড়ি (৯১৪ ফুট) থেকে পাহাড়ী পথে ৫ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছাতে হয় বক্সাদুয়ার।১৯৯৭ থেকে ২ কিলোমিটার গাড়ি যাওয়ার রাস্তা হয়েছে।কিন্তু তারপর হাঁটতেই হবে।এখান থেকে অনেকগুলি ট্রেকিং রুটও আছে।চুনাভাটি, তাসিগাঁও, রূপং,লেপচাখা, ওসেলুম, তাসিডিংকা, কাতলুং নদী এবং জলপাইগুড়ি জেলার সর্বোচ্চ পাহাড় তপগাঁ (৫,৬০০ ফুট)।বক্সাদুয়ারের সামরিক ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে দুর্গের পাশের পাহাড়ে রয়েছে আরো দুটি পিকেট-ম্যাগডালা হিল পিকেট এবং কনিকাল হিল পিকেট।চুনাভাটিতে রয়েছে একটি বহু প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফা এবং ১৮৯৪ সালে ফিনিশ মিশনের তৈরি একটি চার্চ।
বক্সাতে রয়েছে ঐতিহাসিক এক দুর্গেরও ভগ্নাবশেষ এবং তার ওপর ছোটো এক সংগ্রহশালা। ২,৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই দুর্গ।আর বক্সা বন বাংলো অবস্থিত ৩,০০০ ফুট উচ্চতায়।রোভার্স পয়েন্ট ৪,৫০০ ফুট। বক্সা থেকে ৪ কিলোমিটার ট্রেকিং করে রোভার্স পয়েন্ট এবং ১১ কিলোমিটার ট্রেক করে যাওয়া যায় ভূটানের রূপং উপত্যকায় (প্রায় ৬,০০০ ফুট)সিনচুলা রেঞ্জের ‘ জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন ’ বলা হয় রূপং উপত্যকাতে।রোভার্স পয়েন্টের আশপাশ দিয়েই বেরিয়েছে ডিমা, বালা, কাতলুং –র মতো ডুয়ার্সের নদীগুলি। নীচ দিয়ে বয়ে গেছে রায়ডাক নদী, ভূটানে যার নাম ওয়াং-চু।বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পেরই অন্তর্গত ভূটানঘাটের কাছেই ছিলো বন বাংলো। গভীর জঙ্গলে যেখান থেকেই শোনা যেত খরস্রোতা রায়ডাকের গর্জন।জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তিন চার কিলোমিটার পার হলেই মিলবে তিনদিকে পাহাড় ঘেরা একফালি উপত্যকা।পিপিং।সামনে দিয়েই বইছে ওয়াং-চু।তার ওপর ঝোলানো ব্রিজ। তিন দিকেই ভূটান। পাহাড়ে চাষ হয় কমলালেবুর।সেখান থেকে তা নামাননো হয় পিপিং-এ। কমলালেবুর মরসুমে সেখানে বসে অস্থায়ী তাঁবু। দু-চারটে চায়ের দোকান।বক্সাদুয়ারে যাবার অন্যতম পথ সান্ত্রাবাড়ির নামও হয়েছে এই কমলালেবু থেকেই।সনতলা মানে কমলালেবু, তার থেকেই সনতলাবাড়ি, যা অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সান্ত্রাবাড়ি। আবার ডুয়ার্সের আর এক পর্যটন কেন্দ্র সুনতালেখোলার নামও হয়েছে এই কমলালেবু থেকেই। আর বক্সা থেকে জয়ন্তীর দুরত্ব ১৩ কিলোমিটার।অন্যদিকে বক্সা দুয়ার জায়গাটি পরিচিত ছিলো ‘পাশাখা’ নামেও, যা একটি ভূটানী শব্দ, মানে ঘন অরণ্য।অন্যদিকে, চাপড়ামারি, ঝালং হয়ে বিন্দু পার হলেই শুরু ভূটান।পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা সেই এলাকা। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের পূর্ব ডিভিশনের কুমারগ্রামের কুমারগ্রাম আর সঙ্কোশ বিটের মাঝ বরাবার রাস্তা কিংবা জঙ্গলের পথ ধরে চলে যাওয়া যায় ভূটানের কালীখোলার জঙ্গলে।বাংলা-ভূটান-আসাম সীমান্তে সেখানে বইছে সঙ্কোশ নদী।
বক্সা দুর্গটি ঠিক কবে তৈরি হয়েছিলো, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিক রামরাহুলের মতে, মীরজুমলার আক্রমণের ভয়ে কোচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ এখানে লুকিয়ে ছিলেন ১৬৬১ তে, প্রায় বছর খানেক। দুর্গটি ভুটিয়া সম্প্রদায় তৈরি করে ডুয়ার্সে আক্রমণ চালাবার জন্য।ভূটান রাজের সাথে ঐ এলাকার যোগাযোগ ছিলো ক্ষীণ। আসল শাসন চালাতেন ঐ এলাকার সুবা। এই দুর্গটি ‘জং’ নামে পরিচিত।(সূত্রঃ The Himalayan As a Frontier)১৭৭৩ সালে এই দুর্গটি ক্যাপ্টেন জোনস অধিকার করলে এখানে ব্রিটিশদের নজর পড়ে। ১৮৬৪ তে দ্বিতীয় ভূটান যুদ্ধের শেষে ১৯৬৫ সালের ৯ নভেম্বর (মতান্তরে ১১ নভেম্বর) সিনচুলা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইংরেজ অধিকারে স্থায়ীভাবে আসে বক্সা , ১৮৬৫ থেকে তারা দুর্গটি সংস্কার করে।(অ্যাশলে ইডেন) ১৮৬৭-৬৮ পর্যন্ত বক্সা ছিলো মহকুমা সদর।তার পরবর্তীকালে কিছুদিনের জন্য তা স্থানান্তরিত হয় ফালাকাটায়, ফের ১৮৭৪-৭৫ সালে বক্সা পাহাড়ে।আর ১৮৬৯ সালের ১লা জানুয়ারি তৈরি হয় জলপাইগুড়ি জেলা।বক্সা এলাকার রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী পর্যন্ত মিটার গেজ রেললাইন পাতা হয় ১৯০১ সালে। তখন ছিলো বক্সা-জয়ন্তীর গৌরবের দিন।চুন, পাথর, কাঠের ব্যবসা।দিনে বার চারেক ট্রেন, বারবার বাস, তৈরি হয় স্কুল,পোস্ট অফিস, পাম্প হাউস,অফিসারদের থাকার ব্যবস্থা আর দুর্গ,যার একটি অংশ ব্যবহার করা হতো সেনা ছাউনি হিসাবে।তারও আগে ভূটানের সাথে ব্যাবসা বাণিজ্যের একটি পথ ছিলো বক্সা। ভূটান থেকে আসত চীনা রেশমী বস্ত্র,চামর, মৃগনাভি,টাঙ্গন ঘোড়া ইত্যাদি। যে টাঙ্গন ঘোড়ার সুখ্যাতি করা হয়েছিলো আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতেও। অন্যদিকে বাংলা থেকে ভূটানি ব্যাবসায়ীরা নিয়ে যেত নীল, লবঙ্গ, দারুচিনি, কর্পূর, তামাক প্রভৃতি।
১৯১৪ তে বক্সা দুর্গে মিলিটারি ছাউনি বসে ,আর উ‌ ঠে যায় ১৯২৪ সালে।বক্সা দুর্গ জেলখানা হয়ে ওঠে ১৯৩০ সালে।স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম পর্যায়ে ১৯৩০-৩৭ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৪২-৪৭ সাল পর্যন্ত চালু ছিলো বক্সা বন্দী শিবির।প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে সেখানে বন্দী ছিলেন ২৯৩ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী।স্বাধীনতার পরে কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনী ঘোষণা করা হলে ফের কমিউনিস্ট পার্টির বহু নেতা-কর্মীকে পাঠানো হয় বক্সায়।তৃতীয় দফায় বক্সা বন্দী শিবির চলে ১৯৫১ পর্যন্ত।সে পর্যায়ে বিনয় চৌধুরী, প্রশান্ত শুর, সুভাস মুখোপাধ্যায় সহ সেখানে বন্দী ছিলেন ৮৩ জন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মী। (সূত্রঃ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও অন্যান্য সূত্র থেকে তৈরি ‘মেঘের গায়ে জেলখানা ’ সংকলনটির সারণী)১৯৫১ পরবর্তী পর্বে ১৯৫৯ সালে তিব্বতি উদ্বাস্তুদের আশ্রয় শিবির হয় বক্সা।১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলে সেই শিবির। এরপর থেকেই বক্সা ক্রমশ চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।১৯৮৬ সাল থেকে বন্ধ হয়ে গেছে বক্সা-জয়ন্তী রেল।আর ১৯৯৩-র বন্যায় ভেসে গেছে রেল লাইন, পুরানো পূর্ত বাংলো,রেল আবাসন,রেল ব্রিজের খানিকটা অংশ।বন্ধ চুনাভাটির চুন সংগ্রহ, পাথর তোলা, পরিবেশের কারণে প্রায় বন্ধ ডলোমাইট তোলার কাজও।এই এলাকায় ডলোমাইটের বিপুল সম্ভার থাকার কারণে জয়ন্তী-হাতিপোতা আর বাংলা ভূটান সীমান্তের কাছে ভূটানঘাটে নির্বিচারে চলছিলো ডলোমাইট সংগ্রহের কাজ।আর ১৯৮৩ সাল থেকেই শুরু হয় বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কাজ।যার সম্পর্কে ১৮৮৯ সালেই ডুয়ার্সের সেটলমেন্ট অফিসার ডি এইচ ই সান্ডার লিখেছিলেন, No better idea of the forests in the Duars can be obtained than that which you may get almost throughout the year along the Alipur-Buxa Road, Here high Sal, Saj, Champ, Sida and other trees grow luxuriantly and line both sides of the road.’ আর গ্রুনিং-র বর্ণনায়, ‘The scenary near the hills, particularly where the Tista, Jaldhaka, Raidak and Sankos river debouch into the plains is very fine; west of the Torsa the wooded hills of Bhutan with Kinchinjanga in the background from a splendit picture, though the view changes further east where reserve forest intervene between the cultivated land and the hills, these forest are not without a beauty of their own. No better idea of the forest in Duars can be obtained than on the road between Buxa Road Station and Santrabari where the climb up to Buxa. Cantonment begins. Fine Sal trees abound and further north when the orchids are in bloom in March and April, the forests are very beautiful.'
সঙ্কোশ বনবস্তি ছবি : রবীন গোলদার
আবার বক্সার  দক্ষিণ-পশ্চিমে চিলাপাতা জঙ্গলের গড় মেন্দাবাড়িতে রয়েছে নলরাজার গড়ের ধ্বংসাবশেষ।প্রত্নগবেষকদের একাংশের অনুমান, এটি কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ নির্মাণ করেছিলেন। ইঁটের প্রাচীর দিয়ে দুর্গটি ঘেরা। বানিয়াদহ নদী দিয়ে ঘেরা দুর্গটিতবে এটি নরনারায়ণই নির্মাণই নির্মাণ করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে।এই দুর্গের চত্বরে বড় বড় পাথরের স্ল্যাব পাওয়া গেছে।দুর্গটির যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ষোড়শ শতাব্দীর দুর্গের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত বলে স্থানীয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা। ( আনন্দ গোপাল ঘোষ, পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত)
উত্তরবঙ্গের এই অরণ্যগুলিতে মেলে বেশকিছু বিশেষ জনজাতির উপস্থিতি। বক্সা পাহাড়ে যেমন মেলে ‘ড্রুকপা’ বা ‘ডুকপা ’ দের উপস্থিতি, তেমনই জলদাপাড়ার কাছে টোটোপাড়ায় মেলে আর এক আদিম জনজাতি ‘টোটো ’দের উপস্থিতি।এছাড়াও বনবস্তিগুলিতে মেলে মেচ, রাভা,তামাং, ওঁরাও,মুন্ডা, কোরা-র মতো জনজাতিগুলির উপস্থিতি।রয়েছেন লিম্বুরাও।সামগ্রিকভাবে বৈচিত্রময় জলপাইগুড়ির জনজাতিগুলিতে ভাগ করা হয় তিনটি ভাগে। যার মধ্যে রয়েছে ডোয়য়া, খোনিয়া, পানিকোচ, কিচক, জলদার মতো অধুনালুপ্ত মোঙ্গলয়েড জনজাতিগুলিও। তবে মোঙ্গলয়েড শেরপা, ডুকপা, টোটো, কাগাতে, ইউলমো, মেচ, রাভা, লেপচা, গারো, মগ,হাজং, লিম্বু, চাকমা ছাড়াও এই জেলাতেই মেলে ওঁরাও,মুন্ডা, সাঁওতাল, লোধা, শবর, মাহালি, নাগোশিয়া, মালপাহাড়িয়া, হো, বীরহড়, ভূমিজের মতো জনজাতিগুলি।
ভূটান, আসাম, নেপাল, সিকিমের রাজনৈতিক ইতিহাসের পটভূমি আর পূর্ব হিমালয়ের পর্বতমালা, গিরিবর্ত , গহন অরণ্যে ঘেরা প্রকৃতি, বন্যপ্রাণের বৈচিত্র্য আর জনজাতির জীবনযাত্রায় উত্তরবঙ্গের অরণ্য যেন আজও আদিম, ভয়ংকর সুন্দর, মায়াবী আর ভীষণ সবুজ।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: জলপাইগুড়ি জেলার পুরাকীর্তি (আনন্দ গোপাল ঘোষ), ঐতিহাসিক উপাদান ও দলিল চিত্রে জলপাইগুড়ি ( সুনীল চক্রবর্তী ), পর্যটনে জলপাইগুড়ি জেলা ( কৌস্তভ তরফদার), রূপময় জলপাইগুড়ি (জগন্নাথ বিশ্বাস), জলপাইগুড়ি জেলার জনজাতি ( বিমলেন্দু মজুমদার), পাখির স্বর্গে সাত দিন (রাজা পাল), স্বপ্নের রেলগাড়ি ও বকসা জয়ন্তী (অর্ণব সেন), জঙ্গল মহলে (শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়), দ্বিতীয় দার্জিলিং (তুষার প্রধান), কাঁটাতারের বেড়ায় (সুভাস মুখোপাধ্যায়), বন্দীতালিকা (মেঘের গায়ে জেলখানা সংকলন; সঙ্কলকঃ নরেশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ) এবং রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির সহ আরো কয়েকটি ওয়েবসাইট]




Friday, April 08, 2011

না-প্রেম , নাম তিস্তা

কৌশিক সরকার
সম্পর্কটা কেমন? সম্পর্কগুলো কেমন? সেকী এক না একাধিক? ভালোবাসার না না-প্রেমের?
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নাকি একই সুতোয় গাঁথা? নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করেছি বহুবার। একবার নয়, দুবার নয়, তিনবারও নয়, বহুবার।
ভেবেছি, সম্পর্কগুলো কেমন? তিস্তারই মতো নয় কী? যেন প্রায় সমান্তরালে বয়ে চলা এক নদী। কিংবা এক নারী। অথবা এক মন। চলার পথে কখনও-সখনও কাছে আসে। কথা বলে কানে কানে। পরমুহূর্তেই সহসা হারিয়ে যায় ঐ শাল, সেগুনের ভিড়ে। ফের যেন খানিক দুষ্টুমির ছলেই বলে, এই তো আমি। এই লুকোচুরিই যেন চলেছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। এই কাছে আসা, কানে কানে কথা বলা, ফের দূরে চলে যাওয়া, আবার কাছে আসা। ভেবেছি, ভালোবাসা কোনটা? আবেশ না অভ্যাস? বসন্তের সেই বাতাস-যা নেশা ধরায়! না কি সেই মেয়ে, যার উপস্থিতিই বয়ে আনে সেই বসন্ত বাতাসের অনুভূতি! প্রশান্ত, স্মিতহাস্য যে মুখের দিকে তাকালেই যেন বাতাস বইতে শুরু করে ধীর লয়ে। ছড়িয়ে পড়ে সেই প্রশান্তি, তৈরি হয় এক আবেশ।
ভেবেছি, ভালোবাসা কোনটা? এক ক‌ঠিন কর্তব্যবোধ না কি খাঁচাবন্দী এক পাখী? পৃথক সত্ত্বা অভিমানী কিন্তু প্রত্যয়ী কোনো ধারা না কি অভিসারে চলা বহমান অভিসারী ধারার কোনো একটি ধারা মাত্র? অন্তঃসলিলা বা অন্তঃশীলা- কোনো কিছুতেই যায় আসে না তার। ভেবেছি, ভালোবাসা কোনটা? নিভৃতের নগ্ন শরীরী আত্মসমর্পণ না কি অ-শরীরী মনের গোপন কাঙ্ক্ষিত আশ্রয়?
তিস্তা ছবি: শ্যামল মজুমদার
পাহাড়ী পথ আর তিস্তারই মতো যেন বয়ে চলেছে সম্পর্কগুলো। এক নয় বহু, সহস্রধারার মতন। কখনো কাছে আসে।কথা হয় নীচু স্বরে। তারপর হারিয়ে যায় শাল, সেগুনের গহন অরণ্যে, সংসারের চেনা চৌহদ্দিতে কিংবা জনঅরণ্যের বিস্তৃত পরিসরে। পারস্পরিক ভিন্নতাই তাদের অতীত, বর্তমান, হয়তো ভবিষ্যতও। ভিন্নতা মনের অবয়বে, ভিন্নতা শরীরের মাপজোখে, ভিন্নতা বয়সের বিন্যাসে। ভিন্নতা বাস্তবে, ভিন্নতা স্বপ্নে, ভিন্নতা মেধায়-মননে, ভিন্নতা বিত্তে-বৈভবে, ভিন্নতা রিক্তে। তবু যেন রীতিমতো গোলটেবিল বৈঠক করে, টেবিলের ওপর তিস্তার গতিপথের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমই শুধু নয়, ঈশান, মরুৎ সহ দশদিকের ওপরেই আতস কাঁচে গভীর নিরীক্ষণ সেরে, ভাগ বাঁটোয়ারা সারা হয়ে গিয়েছে সেই কবেই। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কালিতে নির্ণয় করে নিয়েছে উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত এবং উৎস থেকে মোহনার দিকে ধাবিত আস্ত একটি জীবনকে।
ভেবেছি, একী অক্ষমতা নাকি সক্ষমতা? একী অতৃপ্তি নাকি তৃপ্তির তুঙ্গে? একী অসম্পূর্ণতা নাকি সম্পূর্ণতারই ব্যাকরণ?
সেভকের করোনোশন ব্রিজের কাছে তিস্তা ছবি:শ্যামল মজুমদার
সে কোন তিস্তা, যে ছিলো আমার প্রথম প্রেম‌ ! ভালোলাগার প্রথম আবেশ,ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি, যৌনতার প্রথম পাঠ। ছুঁতে চাওয়ার আকুতি। সেকী ছিলো শুধুই বিস্তৃত জলধারা, বেগবান, খরস্রোতা। কখোনো নীল, কখোনো সবুজ, স্বপ্নে নীলাভ-সবুজ। আবার মেঘলা আকাশের নীচে যেন ঘোলাটে, জটিল বহমান এক আবর্ত। তিস্তা মানে কী শুধুই সেই জলধারা, ভোরের বাতাসে যার ছন্দে ভৈরবের সুর, মধ্যরাতে দরবারী কানাড়ার, কিংবা মন খারাপ করা কোনো বিকেলে বেহাগের বিষণ্ণতা কিংবা সন্ধ্যারাতে বাগেশ্রীর। তিস্তা মানে কী সেই সাদা নুড়ি বিছানো বিছানা নয়, নীলাভ সবুজ ধারাকে যা ফ্রেমবন্দী করে উজ্জ্বল সাদায় ? কিংবা শাল-সেগুন-শিশু-শিমুলের সেই অরণ্য যা কখনও আড়াল তোলে কালরাত্রির মতো, মিলনে উদগ্রীব দুটি প্রাণের মিলনের ইচ্ছাটুকু আরো খানিকটা জারিয়ে দিতে। যেমন পাতাগুলো চেটেপুটে নেয় প্রথম বর্ষার বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা, দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে। প্রথমে ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন, বিরামহীন সেই সম্ভোগ, খানিক সম্বিৎ ফিরলে উজ্জ্বল সবুজে যার আত্মপরিচয় প্রকাশ। তখন বেশ ঠাহর করা যায়, সবুজেরও সেই তারতম্য। শালের সবুজ আর জারুলের সবুজে ফারাক ঠিক কতখানি!
এই বোধই কী অনুভূতি? তা যদি না হয়, তবে আমাজনের অরণ্য আর মহানন্দার অরণ্যেই বা কী ফারাক? বিষ্ণুপুর, বান্দোয়ান, বাঘমুন্ডি আর ঝাড়গ্রামের শালের বনের সাথে কতটা ফারাক কালচিনি কিংবা কুমারগ্রামের শালবনের? সে কী শুধুই জ্যামিতিক মাপজোখেই বিচার্য? হৃদয়ের উষ্ণতায় তার বিচার চলে না? রঙের বাহার তবে তো নিছকই আতিশয্য। জল-জঙ্গল সেখানে প্রাণহীন, অর্থহীন এক ঘোষণা মাত্র। তিস্তা মানে কী সেই বন্যপ্রাণ কিংবা তিস্তাপারের সেই জনবসতি বা  সেই জনজীবনও নয়? কিংবা তিস্তার তটে কোনো কদম ছায়া আর বর্ষার কদমের গন্ধও? তা যদি না হতো, তবে কী তিস্তা রঙে-রূপে-বর্ণে-গন্ধে এক মূর্ত উপস্থিতি লাভ করতো? কখনও করতো? করতো কখনও?
সুন্দর না সুন্দরী? কীসে মোহিত আমি? সুন্দরীর লিঙ্গ সুনির্দিষ্ট, সুন্দর লিঙ্গের উর্ধ্বে। প্রখর মেধা-গ্রীষ্মের মতোই যার প্রখর দীপ্তি, তাকে পছন্দ বা অপছন্দ করা চলে, অস্বীকার করা যায় না। বর্ষার সজীব অভিমান-অবিরাম যা ঝরে ক্লান্তিহীন ভাবে, ভীষণ ভালোবেসে যাকে জড়িয়ে ধরা যায় কিংবা করা চলে নিতান্ত অস্বীকার, ঘ্যানঘ্যানে, প্যানপ্যানে-এই অছিলায়। শরতের নীল আকাশের ঔদার্য- যার কাছে অবলীলায় কবুল করা যায় নিজের গোপনতম অপরাধটিও। হেমন্তের স্নিগ্ধ মেদুরতা, আলো-আঁধারির সন্ধিক্ষণে যার অবস্থান-কিছু থাকে সোচ্চারে, খানিক অস্ফুটে। শীত- অস্থিত্ব জানান দেবে যে প্রতিটি পদে, তার বশ মানানো ব্যক্তিত্বে, তার কৃতিত্বে কিংবা নিভৃত নিরালার উষ্ণতায়। নাকি নেশা ধরানো অমলিন, অম্লান বসন্ত বাতাস-স্রেফ যার উপস্থিতিই বুনে চলে আবেশ আর উষ্ণতার এক নতুন জ্যামিতি, গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হয় যে মুগ্ধতার আবেশ, মনে আনে প্রশান্তি, ভালোলাগা আর ভালোবাসার এক বিশুদ্ধ অনুভূতি। কোনটাতে অধিকার? কোনটা ভালোবাসা? অনধিকারই বা কীসে? মন্দবাসাই বা কোনটি? আজ ফের নতুন করে পথ চলা শুরু হলে, মেঘের ডানায় ভর করে ফিরে চাইতাম কোনপানে? কোন অভিমুখে বইতো ধারা-উৎস থেকে মোহনায়?
ভালোবাসা-মন্দবাসার প্রথাগত ধারণা এখন অলীক। যেমন অর্থহীন গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্তের কাল্পনিক সীমারেখাও। ঘরে-বাইরের বিভেদ এখন অশালীন। ঘরে-বাইরের আড়াল ঘোচাবার জন্য একফালি পর্দাও এখন আতিশয্য, অনাবশ্যক। নগ্নতাই এখন বাস্তব। নগ্নতা স্বপ্নেও। নগ্নতা কোলাহলে।নগ্নতা নৈঃশব্দ্যে। নগ্নতা প্রেমে। নগ্নতা না-প্রেমেও।
এখন সোজা-সাপটা তাকাতে পারে তোমার চোখে, আমার চোখ।দুদিন আগেও যা আড়াল খুঁজতো। এখন সম্পূর্ণ নগ্নভাবে দাঁড়াতে পারি তোমার সামনে। দুদিন ‌আগেও যা ভেবে কান লাল হতো। এখন সম্পূর্ণ নগ্নভাবে অক্লেশে, অবলীলায় বলে যেতে পারি নিজের গোপনতম অপরাধের কথা। এখন অবলীলায় হাত বুলাতে পারি তোমার নগ্ন দেহে, দুদিন আগেও যা ছিলো কল্পনার অতীত। সম্পর্ক, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরের সব হিসাবই এখন অলীক। ছয় ঋতুর কোনোটির মুগ্ধতার আবেশেই এখন দিন কাটে না। বছরও ঘোরে না।জীবন মানে এখন মুহূর্তের জন্য বাঁচা। আবার অন্তহীন পথ চলাও। পরবর্তী মুহুর্তের প্রতীক্ষায়। গ্রীষ্মের মেধার প্রখর দীপ্তিতে এখন কাটি-ছিঁড়ি বর্ষাকে। আর বর্ষার সজীব আলিঙ্গনে নিঃশ্বাস ফেলি বসন্ত বাতাসের জন্য। আবার যখন বসন্ত আসে এই প্রাণেই, তৈরি হয় এক আবেশ, তখন ভাবি হেমন্তের নরম রোদে সেই ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তগুলোর কথাই। শীতের মধ্যেও খুঁজে ফিরি, বৈশাখের উষ্ণতাকে। চরিত্রগত ভাবে যার অবস্থান সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে, যেমন শীত আর গীষ্ম, সাদা আর কালো, আলো আর অন্ধকার।তবু সেই বৈপরীত্যেই খুঁজি সম্পূর্ণতা। যেমন গ্রীষ্মকে খানিক সহনীয় করে নিতেই কামনা করি বর্ষাকে। তেমনই গ্রীষ্মে শীতের কথা। শরৎ, হেমন্ত আর বসন্তের ব্যক্তিত্ব ভারী মিষ্টি, আদুরে। অনায়াস, স্বচ্ছন্দ বিচরণ চলে যার সীমানা অতিক্রম করেই। আর অজান্তেই তৈরি হয়ে যায় সম্পূর্ণতার এক নতুন সংজ্ঞা।
এ সংজ্ঞা দেবতার। কারণ, তিনি সর্বপূজ্যা। তাতে বাছ-বিচার নেই। এ সংজ্ঞা জননেতার। কারণ, গোপনীয়তায় মালিকানা নেই তারও। এ সংজ্ঞা সর্বভোগ্যার। কারণ, নগ্নতাই তার বাস্তবতা। এ সংজ্ঞা হা-ভাতেরও। কারণ, সে সর্বংসহা। জীবন যাকে পরিত্যাগ করেছে, বঞ্চনাই যার নিত্যসঙ্গী, কিন্তু স্বপ্নে যার আজও অধিকার। এ সংজ্ঞা হয়তো তেমন কারোরও, ভালোলাগা, ভালোবাসা আর যৌনতার প্রথম পা‌ঠ যে শিখেছিলো, কোনো নদীর কাছে, খোলা আকাশের নীচে। মূর্ত-বিমূর্তের ছক বাঁধা জীবনকে অস্বীকার করতেও। মূর্তে-বিমূর্তে, গ্রীষ্মের প্রখর দীপ্তিতে এবং বর্ষার ধারায়, শীতের উষ্ণতায় আবার প্রাণখোলা বসন্ত বাতাসে, শরতের ঔদার্যে কিংবা হেমন্তের পেলবতায়, সৌন্দর্যে কিংবা বীভৎসতায়, উৎস কিংবা মোহনায়, নগ্নতায় এবং আড়ালেও, ঋষির মগ্নতায় কিংবা শিশুর সারল্যের অলীক কল্পনার ধূসর সাম্রাজ্যে, নিষিদ্ধ শব্দের নাম তাই ‘ভালোবাসা’ আর না-প্রেমের নাম তিস্তা।

Wednesday, April 06, 2011

যেখানে সন্ধ্যা নামে সূর্য ডোবার অনেক আগেই


[জলপাইগুড়ির রাঙামাটি চা-বাগান।ছবি: শ্যামল মজুমদার]
কৌশিক সরকার

দেশটা যদি পুরানো হয়, তবে তার একটা ইতিহাস থাকবেই। নতুন হলেও থাকবে, পুরানো ইতিহাসের কোনো সূত্র।সে ইতিহাস বহুল চর্চিতই হোক বা আদৌ না-চর্চিত।তা আলোকেই থাক বা অন্ধকারে।হরপ্পা- মহেঞ্জোদারোর সময় থেকেও শুরু করে ব্রিটিশ শাসন  পর্যন্ত সময়কালকে যদি বিবেচনায় রাখা যায়, তবে ভারতের ইতিহাস কেবলমাত্র উত্তরভারত , উত্তর-পশ্চিম ভারত বা দাক্ষিণাত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। দীর্ঘ এই সময়কালে, বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী দেশের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব প্রান্তও। যদিও, সে ইতিহাস অনেকাংশেই আজও অবহেলিত।অথচ, স্থানীয় মানুষের মনে তার জায়গা, তাকে ঘিরে আবেগ, অনুভূতি কিন্তু আজও রয়েছে।
মহাকাব্যের বর্ণনায় কুরুক্ষেত্র প্রান্তর যা ছিলো এক যুগসন্ধিক্ষণের সাক্ষী, কিংবা পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, যা পরবর্তী প্রায় পাঁচশো বছরের জন্য ভারতে রচনা করেছিলো মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি, সে ইতিহাস আলোচিত। বস্তুত, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জয়ের পর ভারতে মোঘলদের দ্বারা নির্মিত প্রথম পরিকল্পিত নগর ফতেপুর সিক্রিও আজ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে এক অন্যতম গন্তব্য। সে কথা সুখের। কিন্তু, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি পরবর্তী প্রায় দুশো বছরের জন্য রচিত হলো যে প্রান্তরে, সেই পলাশী কিন্তু আজও নিঃসঙ্গ, একাকী।আবার স্বাধীনতার লড়াইয়েও দেশের প্রধান তিনটি স্থানের মধ্যে পাঞ্জাব আর মহারাষ্ট্রের সঙ্গে কিন্তু একইসঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলো বাংলাও। ইতিহাস মানে কেবল রাজা-রাজরার কাহিনীও নয়, যদিও এদেশে সংগঠিত ইতিহাস চর্চায় তাই পেয়ে এসেছে এক ভারসাম্যহীন গুরুত্ব।আর, তাই ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য বলতে যা বোঝায় , তাও তৈরী হয়েছে সেই চর্চিত ইতিহাসকে কেন্দ্র করেই, তাকে সংরক্ষণের মাধ্যমেই। মহাভারতের কথাই যদি ধরা যায়, চিত্রাঙ্গদাও তো মণিপুরের রাজনন্দিনী। সে কথা অনেকেরই অজানা। অনেকেই হয়তো জানেন না, বক্তিয়ার খিলজীর সমাধি আজকের দক্ষিণ দিনাজপুরে।আবার, মহাভারতের ট্র্যাজিক নায়ক কর্ণ-র নাম থেকেই উৎপত্তি কর্ণঝোড়া এবং করণদীঘির।যেমন একথাও কম আলোচিত যে একান্নপীঠের পাঁচটি পীঠই বীরভূমে। অনেকেই হয়তো জানেন না, উত্তরবঙ্গের তিন জেলা, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার আর দার্জিলিঙেই রয়েছে অন্তত আট-আটটি জাতীয় উদ্যান কিংবা অভয়ারণ্য।রয়েছে এমন আরো বহু নিদর্শনও।
কাঞ্চনজঙ্ঘায় ভোরের রাগ ছবি: সৌগত চ্যাটার্জী

এও যেন অর্থনীতির ‘দারিদ্রের দুষ্টচক্র ’ –র মতোই। সংগঠিত ইতিহাস চর্চা নেই তাই সেই সংরক্ষণের দায়। সংরক্ষণ নেই তাই নেই পর্যটন আকর্ষণ। আকর্ষণ নেই তাই নেই চর্চাও।অথচ কী নেই পশ্চিমবঙ্গে? না, মরূভূমি নেই। মরুদ্যান ? সে প্রসঙ্গ থাক।আছে , বিরল ম্যানগ্রোভ অরণ্য, আছে নদী-নালা ঘেরা সুন্দরবন, আছে সমুদ্র, আছে ব্রিটিশ শাসনের স্মারক, স্থাপত্য, ভাস্কর্য; আছে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসও, আছে ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণের ইতিহাসও। ইতিহাসের গতিপথের পথ পরিবর্তন উদ্দেশ্য নয়, নয় তার নির্বাচিত গৌরবময় অধ্যায়ের চর্চাও, উদ্দেশ্য তার প্রকৃতি, পরিবেশ, ইতিহাসের চর্চাই, যে ইতিহাস রাজা-রাজরারও, আবার অতি সাধারণ কোনো জনজাতির, যে জীবনচর্চাতেই রয়েছে অসাধারণ সব টুকরো টুকরো ছবির এক কোলাজ। এরাজ্যেই আছে গৌড়, পুন্ড্রবর্ধন সহ কোচবিহার রাজবাড়ি কিংবা বৈকুন্ঠপুর এস্টেটের ইতিহাস। রয়েছে, গুপ্তযুগের সময়কালের নিদর্শন সহ পাল, হুসেন শাহী সময়কালের নিদর্শন, পুরাকীর্তি। বস্তুত, ১৫১০ খৃষ্টাব্দ থেকে কোচবিহার রাজবংশের সুষ্পস্ট ইতিহাস পাওয়া যায়।আর অতীতের বৈকুন্ঠপুর, যা আজকের জলপাইগুড়ি,সেই এস্টেট তৈরি হয়েছিলো ১৫৪৫ খৃষ্টাব্দে। তবে পশ্চিমে গৌড়,উত্তরে নেপাল,ভূটান এবং পূর্বে আসাম প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সাবেক সীমানা ঠেলাঠেলি করে কখনও বড়, কখনও ছোটো, আবার কখনও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে হতে স্বাধীনতার সময়কার কোচবিহার রাজ্যে এসে ঠেকেছিলো।তারমানে ভারতে মোঘল শাসনের সূত্রপাতের আগে থেকেই মিলছে কোচবিহারের রাজবংশের সুস্পষ্ট ইতিহাস। আর বৈকুন্ঠপুর এস্টেট যখন তৈরি হচ্ছে, ততদিনে চৌসা আর বক্সারের যুদ্ধে শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে মোঘল সম্রাট হুমায়ুন প্রমাদ গুনছেন।অন্যদিকে আজকের মালদহ জেলার ইতিহাসও পুরানো।প্রাচীন রাজধানী গৌড় থেকে কর্ণসুবর্ণ, লক্ষণাবতী হয়ে ফের গৌড়ের পুননির্মাণের মধ্যেই রয়েছে পুন্ড্রবর্ধন,শশাঙ্ক,গুপ্ত,পাল,সেন,হুসেন শাহী সুলতানী সাম্রাজ্য হয়ে মাৎস্যন্যায়ের ইতিহাস। যে ইতিহাসের পথ বেয়েই আজকের মালদহ, দিনাজপুরের জন্ম।মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু অংশেও মেলে সেই ঐতিহাসিক নিদর্শন।
আপন খেয়ালে ছবি:সৌগত চ্যাটার্জী

এরাজ্যেই আছে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের বেলুড়,শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ, রামমোহন-বিদ্যাসাগর সহ সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অসংখ্য নিদর্শন।আছে তাম্রলিপ্তর ইতিহাস এমনকী বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারকালের নিদর্শনও।আছে, দেড়শো বছর আগে স্থাপিত ব্রিটিশ মালিকদের দ্বারা স্থাপিত চা-বাগানের ইতিহাস, ‌আছে দেড়শো বছর আগেই ছোটোনাগপুর, মধ্যপ্রদেশের মতো এলাকাগুলি থেকে ছিন্নমূল হওয়া আদিবাসীদের ইতিহাসও। এক জলপাইগুড়ি জেলাতেই রয়েছে, এমন ছাব্বিশটি জনজাতির অস্থিত্ব। যা নিছক কম পাওয়া নয়। এদের মধ্যে যেমন অস্ট্রিক শাখার জনজাতিরাও রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন মোঙ্গলয়েড জনজাতির বাসও, যাদের একটি বড় অংশের জীবন আজও আবর্তিত হয় জঙ্গলকে কেন্দ্র করেই। তাই রয়েছে গহন অরণ্যও- বক্সা, চিলাপাতা, জলদাপাড়া, গোরুমারা, চাপড়ামারি, মহানন্দা, শিঙ্গালিলা ,নেওড়া ভ্যালী। আবার, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলেও রয়েছে এমন অরণ্য।রয়েছেন,আদিবাসী মানুষেরাও।
মূর্তি নদী ছবি: সৌগত চ্যাটার্জী

তিস্তা, তোর্ষা, জলঢাকা, রায়ডাক, সঙ্কোশ, মহানন্দা, কালজানি, ডায়নার মতো নদী আর বক্সা, চিলাপাতা কিংবা চাপড়ামারির মতো অরণ্য; জল-জঙ্গলে যেন প্রতিনিয়ত রচনা করে চলেছে অপূর্ব, নৈসর্গিক সব চিত্রকল্প। চিলাপাতার মতো অরণ্য, তোর্ষার ধারে যার ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায়, একদিকে বক্সা, অন্যপ্রান্তে জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। আবার বক্সা পাহাড় থেকেই পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় ভূটানের রূপম ভ্যালী। ঠিক যেমন কোচবিহার, হাসিমারা কিংবা আলিপুরদুয়ার থেকে সড়ক বা রেলপথে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছানো যায়, আসাম কিংবা ভূটানেও। কিংবা নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে পৌঁছানো যায় পার্শ্ববর্তী সিকিম, নেপাল কিংবা বিহারেও। আবার নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া থেকে মাল, মেটেলি,ওদলাবাড়ি, বানারহাট, নাগ্রাকাটা, মাদারিহাট, কালচিনি, ‌আলিপুরদুয়ার, কুমারগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে অসংখ্য চা-বাগান। যেমন রয়েছে কার্শিয়াং, কালিম্পং, দার্জিলিঙের পাহাড়েও। উত্তরবঙ্গ তাই হতেই পারে পর্যটকদের স্বাভাবিক পছন্দ।
ক্রীড়া এবং পর্যটনের মধ্যেও একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। উভয়ের মধ্যেই সঙ্কীর্ণতার স্থান কম। উভয়েই ভাঙে ভেদের বেড়া। যে মানুষ মিশরের নীল নদ কিংবা পিরামিড উপভোগ করেন, তিনি সমান আগ্রহেই দেখেন আমাজনের অরণ্য। কিংবা যিনি তাজমহল দেখেন, তিনিই দেখেন গ্রান্ড ক্যানিয়ন। যিনি, কেরালার কোভালম সমুদ্র উপভোগ করেন, তিনিই সমান উপভোগ করতে পারেন জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। আবার, পর্যটকের মানসিকতাও একইরকম নাই হতে পারে। কারো পছন্দ সমুদ্র, তো কেউ পছন্দ করেন পাহাড়। আবার কারো পছন্দের তালিকায় অরণ্য। যিনি অরণ্য পছন্দ করেন, তার আকর্ষণ খানিক কম থাকতেই পারে ইতিহাসে, কিংবা ধর্মীয় স্থানে।তাই বৈচিত্র যেখানে বেশী, পর্যটনের সম্ভাবনা সেখানে ততই উজ্জ্বল। এই বৈচিত্র আছে এরাজ্যে, তার এক আকর্ষণীয় পসরা সাজানো আছে উত্তরবঙ্গে।

বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প ছবি : অমিত কর

বাস্তবতা হলো, সেই সম্ভাবনার অনেকটাই আজও বিকশিত হয়নি। আবার একথাও সমান সত্যি, বিগত বছরগুলিতে তা থেমে নেই একই স্থানে।এগিয়েছে, নিশ্চিতভাবেই এগিয়েছে। তার সাক্ষী তথ্য, পরিসংখ্যান, তার সাক্ষী অভিজ্ঞতাও। কিন্তু সমস্যা হলো, তার যথাযথ বিপণন, প্রচারের যেমন ঘাটতি আছে, তেমনই ঘাটতি রয়েছে পর্যটকদের প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি যথাযথ ভাবে উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও।তাই এমন অভিজ্ঞতাও বিরল নয়, যেখানে নিছক অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা। বলাই বাহুল্য, সে অভিজ্ঞতা সবসময়ে সুখের নয়। পরিণামে, যা হতে পারতো জীবনের এক বড় পাওনা, তাও কখোনো সখনও হয়ে দাঁড়ায় এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। এখনও নিশ্চিতভাবেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণের, এবং সে কাজ মূলত সরকারেরই। তারসঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারী সংস্থাগুলিও পালন করতে পারে তাদের ভূমিকা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কারণ, তা না করা গেলে সাধ আর সাধ্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া ছাড়া বিশেষ করণীয় কিছু থাকে না।
তবু, যে পথ পার হওয়া গেলো তাও কম কিছু নয়। আজও সেখানে কোথাও কোথাও সন্ধ্যা নামে সূর্য ডোবার অনেক আগে‌ই। দূর পাহাড়ে জ্বলে ওঠে ওঠে সারি সারি আলো। পাহাড় সাজে যেন দীপমালায়। একদিন নয়, প্রতিদিন.






Tuesday, April 05, 2011

Destination North Bengal


প্রকৃতি যেখানে মোহময় ছবি: অমিত কর
 Centre: Alipurduar/Hasimara [Nature]
Spots: 1] Barodabri  2]Nilpara 3]Chilapata 4]Kodalbustee 5]Bhutanghat 6] Jayanti 7]Jayanti Mahakal 8] Buxaduar 9] Barobisa-Shilpara 10] Kumargram Rest House 11]Rajabhatkhawa 12]Leo House 13]Tiger Lodge 14]Raimatang 15]Nimati 16]RBK-Buxa Jungle Lodge 17]South Rydak 18] Mendabari  19] Rashikbeel 20]Kunjanagar 21]Madarihat (Jaldapara Wild life Sanctuary) 22]Halong (Jaldapara) 23] Totopara 24]Jaigaon 25] Volka 26]Hatipota 27]South Khairbari 28]Kathambari 29]Santrabari
Spots: [Bhutan]
Spots: [Assam]
 
জীবন যে রকম ছবি : রবীন গোলদার

Centre: Jalpaiguri/ Lataguri (Mal/Moynaguri) [Nature]
Spots:1] Gorumara National Park 2] Lataguri 3]Chapramari 4]Jalpesh 5] Murti 6]Chalsa 7]Malbazar 8]Matiali 9]Samsing 10]Odlabari 11]Ambari 12]Bodagunge 13]Khuttimari 14] Rangamati 15]Gorubathan 16] Jaldhaka 17]Suntalekhola 18]Jhalong 19]Bindu 20] Gahanbari (Gehobari) 21]Kalipur Forest Village 22]Bandapani 23]Batabari 24]Panjhora 25]Bichabhanga Forest Village 26]Sulkapara 27] Kathambari 28]Kalokhaowa 29]Ramshai 30]Dhupjhora  31]Boikunthapur Forest Lodge (on the bank of Teesta) 32]Paren
Centre: Siliguri (New Jalpaiguri) [Nature]
Spots: 1] Darjeeling 2] Kurseong 3] Kalimpong 4]Lava 5]Lolegaon 6]Rishop 7]Mongpong 8]Rangpo 9]Rimbik 10]Lepchajagot 11] Rohini 12] Chuikim 13] Kakjhora 14] Rammam 15] Mirik 16] Mangpoo 17]Srikhola 18] Palmajua 19]Kalijhora 20]Sandakphu 21] Neora Valley National Park 22] Tinchulay
[Local sightseeing at Darjeeling: Pashipati Nagar,Tiger Hill, Batasia Loop,Yiga-Cholang Buddhist Monastery,Himalayan Mountaineering Institute, Zoological Garden,Ropeway, Toy Train journey, Lebong Race Course, Tibetan Refugee Self Help Centre, Tensing Rock, Rock Garden, Gangamaya Park,Durpindara,Dr. Graham’s House, Japanese Temple, Lal Kuthi, Ava Art Gallery, Dhirdham Temple, Natural History Museum]
Spots: [Sikkim]
Spots: [Nepal]
Spots: [Bihar]
Centre: Coochbehar [Historical/Religious]
Spots:  [Religious ] 1]Madan Mohan Temple 2] Baradevi Bari (Coochbehar) 3] Brahmo Mandir (Coochbehar) 4] Dangar Ayee Temple (Coochbehar) 5] Siddheswari Kalibari (Coochbehar) 6]Kamteswari Temple (Gosanimari) 7]Madan Mohan Temple [Mathabhanga] 8]Siddhanath Siva Temple [Dhaluabari] 9]Madhupur Dham Temple [Madhupur] 10] Ardhanariswar Temple [Baneswar]
Spots: [Historical/Heritage] 1]Royal Palace [Coochbehar] 2] Old Collectorate Building 3] Moti Mahal or Kalyan Bhavan 4]Lalbagh 5]Head Post Office 6] Carmichael Ward 7]Ananda Ashram 8] Bhola Ashram 9]Parijat Villa 10]Circuit House-(1) 11] Motor Vehicles 12]Chilarai Barrack 13] ABN Seal College 14]Jenkins School 15]Jenkins School Hostel 16]MJN Club 17]Rani Bagan 18]Victor Palace 19]Hiranyogarbho Shiv Temple 19]Tank in memory of 1971 war 20] Gosanimari Excavation [Dinhata]
Centre : Malda [Historical]
Spots:[ Ramkeli ] 1]Baroduari /Boro Sona Mosque 2]Dakhil Darwaja 3] Firoz Minar 4]Chamkati Mosque
[Gour] 5]Chika Mosque 6]Lukochuri Gate 7] Kadam Rasul Mosque 8]Tomb of Fateh Khan 9]Tantipara Mosque 10]Lattan Mosque 11]Kotwali Darwaja 12]Gumti Darwaja [Adina] 13] Adina Dear Park(Nature) 14]Hamam Ghar 15]Turkey Bathroom 16] Pandab Dallan Minar 17]Atbart Dighi 18]Adina Mosque [Pandua] 19] Kutub Shahi Mosque 20]Eklakhi Mausoleum 21]Jagjibanpur

Spots: [Other historical spots of Murshidabad]
Centre: Balurghat (Balurghat/Malda) [Historical/Nature]
Spots: 1]Sarongbari(Hili) 2] College Museum (Balurghat) 3]Khanpur (Balurghat) 4]Patiram Thakur Estate (Balurghat) 5] Bolla Kali Temple (Balurghat) 6] Mahipal Dighi (Kushmandi) 7]Aira Forest [Kushmandi] 8] Bangarh [Excavation](grave of Bakhtiar Khilji) 9]Dhal Dighi(grave of Atash Fakir) 10]Kal Dighi (Migratory Birds)[Gangarampur] 11] Bairhatta (Alta Dighi, Milian Dighi, Gor Dighi,  Hatidoba Dighi) [Harirampur] 12] Manohali (Tapan)

Centre : Raiganj [Nature/Religious]
Spots: 1]Raiganj Bird Sanctuary (Kulik) 2] Sap Nikla Forest (Chopra) 3]Eco-tourism Project (Bijolia) 4]Bairabhi Temple (Bindole) 5] Museum at Karnajora 6]Banabithi Resort at Barui (Barduari) 7]Samaspur Farm House [Hemtabad] 8]Kali Temple at Baira 9] Mosque of Burhana Fakirs
বাংলা-ভূটান-আসাম সীমান্ত ছবি: রবীন গোলদার


Monday, April 04, 2011

প্রকৃতির কোলের ঠিকানা লাটাগুড়ি আজ খুলে দিয়েছে আয়ের রুদ্ধ পথ

লাটাগুড়ির প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। ছবি: রবীন গোলদার
কৌশিক সরকার
মেঘলা দিনে শেষ বিকেলের বাতাস ভেজা। বৃষ্টি হয়েছে, কখনও টিপটিপ, কখনও ঝমঝম। তির তির করে বইছে মৃদু মন্দ বাতাস। ইঙ্গিত রয়েছে, রাতে ফের বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি ধোয়া জলে জঙ্গলের গাছগাছালিগুলো যেন এখন আরও সবুজ। তবু সব সবুজ যেন এক নয়। ফারাক বেশ মালুম হয়। হাত কয়েক দূরে বয়ে চলেছে ন্যাওড়া নদী। এখনও অলস, এখনও মন্থর। দূরের জঙ্গলে একে একে সন্ধ্যাদ্বীপের মতো জ্বলে উঠছে জোনাকি। এক নাগাড়ে ঝিঁঝির আওয়াজ। থেকে থেকে যেন ডেকে উঠছে কোনো বউ-কথা-কও। আর কাছে-দূরে গাছে গাছে কেকা। বেশ বোঝা যাচ্ছে, একটি নয়, দু’টি নয়, অন্তত ডজন খানেক ময়ূর রয়েছে ধারে পাশের গাছগুলিতেই। তারপর সন্ধ্যা নামলো। আর ...‘থাকে অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার।’



কলোখাওয়া ওয়াচ টাওয়ার। গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। ন্যাওড়া নদীর ধারে, জঙ্গলের অভ্যন্তরে সুসজ্জিত পর্যটক কটেজ। গোরুমারার সর্বশেষ সংযোজন। এখনও তেমন পরিচিত হয়নি পর্যটকদের কাছে। কিন্তু ডুয়ার্সের পর্যটন সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন গত ক’বছরে লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে নতুন ভাবে সাজানো হচ্ছে ডুয়ার্সের পর্যটনকে। গড়ে উঠেছে ৩৩টি নতুন পর্যটক আবাস। বেসরকারী উদ্যোগে। এখন একসাথে থাকতে পারেন প্রায় পাঁচশো পর্যটক। ৩৩টি পর্যটক আবাসের মধ্যে এগারোটিই স্থানীয় উদ্যোগপতিদের। এছাড়াও রয়েছেন জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, শিলিগুড়ি এবং কলকাতার উদ্যোগপতিরাও।
হাত বাড়ালেই গোরুমারা ছবি : সৌগত চ্যাটার্জী
ইকো-ট্যুরিজমকে (প্রকৃতি-পর্যটন) ভিত্তি করেই ডুয়ার্সের পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম গন্তব্য হিসাবে ইতোমধ্যেই উঠে এসেছে লাটাগুড়ি। বলছিলেন আশিস সরকার। লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে এই কর্মযজ্ঞের অন্যতম নেপথ্য কারিগর যে তিনিই, একথা স্বীকার করছেন হোটেল মালিক থেকে ভ্যান-রিকশা চালক কিংবা গাড়ির চালক। এর ফলে শুধু যে পর্যটকরাই উপকৃত হচ্ছেন তা নয়, এক অর্থনৈতিক বদ্ধদশা থেকেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে লাটাগুড়ি। মূলত এক দশকে। তবে প্রকৃতি পর্যটন মানে এখানে খানিক জঙ্গল, খানিক পর্যটনের মশালা মুভি নয়।

অরণ্য, টাস্কার্স ডেন-এর মতো ট্যুরিস্ট লজ মালিকদের অনেকেরই পুরানো ব্যবসা ছিল কাঠের। অরণ্য রিসর্টের মালিক শুভাশিস চ্যাটার্জি জানালেন, ১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ আইন চালুর ফলে অনেকটাই মার খায় লাটাগুড়ির কাঠের ব্যবসা। সে সময়ে লাটাগুড়িতে ছিল ১৫টি শ’মিল, একটি প্লাইউড মিল। এছাড়াও রেলের স্লিপার এবং বিদ্যুতের খুঁটিও সাপ্লাই যেতো লাটাগুড়ি থেকে। শ’মিল, প্লাইউড কারখানা সহ এই কাজগুলিতে যুক্ত ছিলেন প্রায় হাজার খানেক শ্রমিক। কাঠের ব্যবসা মার খাওয়ায় ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে মিলগুলি। কাজ হারান শ্রমিকরা। শুরু হয় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিন গোনা। সেই প্রেক্ষিতেই ফের মোড় ঘোরায় এই প্রকৃতি পর্যটন।
আয় এখন? অরণ্য, ময়ূর, লেক ভিউ, সোনার বাঙলা, পাশাখা, টাস্কার্স ডেন, গ্রিন ভিউ, সবুজ সাথী, বনানী, গ্রিন লেগুনের মতো রিসর্টগুলির মালিক লাটাগুড়ির উদ্যোগপতিরাই। এক সময় তাঁদের অনেকেই ছিলেন টিম্বার মার্চেন্ট। একে কেন্দ্র করে লাটাগুড়িতেই এখন স্থানীয় যুবকরা কিনেছেন প্রায় দেড়শো গাড়ি। বাপী চন্দ্র, বাপ্পা গাঙ্গুলি, নাকু গোপের মতো যুবকরা এখন পর্যটনকে কেন্দ্র করে গাড়ির ব্যবসা করেই সংসার চালাচ্ছেন। ধীরেন কোড়া, দুকু কোড়া, দুর্জন কোড়া, রাজেশ ওঁরাওদের মতো প্রায় ৭০ জন আদিবাসী যুবক এখন করছেন গাইডের কাজ। বিচাভাঙা বনবস্তি, সরস্বতী বনবস্তি, ধূপঝোড়া, রামসাইয়েই তাঁরা থাকেন। ট্যুরিস্ট গাইড ধীরেন কোড়াই জানালেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে বন দপ্তর। গাইডের ফি গাড়িপিছু একশো টাকা। আরও জানালেন, এ’কাজ করে এখন মাসে গড়পড়তা দেড় হাজার থেকে দু’হাজার টাকা আয় হচ্ছে তাঁদের। আগে বনের শুকনো কাঠ, রুল, ছত্রাক কুড়িয়ে বিক্রি করেই দিন গুজরান হতো তাঁদের। এছাড়া পর্যটনকে কেন্দ্র করেই নানা হস্তশিল্প সামগ্রীর দোকান, অন্যান্য দোকান বাজারেরও বিরাট সম্প্রসারণ ঘটেছে লাটাগুড়িতে, আগে যেখানে ছিল ভাঙা কাঠের গুটিকয়েক দোকান। এমনকী লাটাগুড়িতে ফরেস্ট ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারের টিকিট বিক্রি করে যা উপার্জন হয়, তারও ২৫ শতাংশ অর্থ ভাগ করে দেওয়া হয় বনবস্তিগুলির পরিবারগুলির মধ্যে। জানালেন বিচাভাঙা বনবস্তির ধীরেন কোড়া, যিনি এখন ট্যুরিস্ট গাইড। এখানকার ইকো ট্যুরিজম রেঞ্জের রেঞ্জার শম্ভু সূত্রধর জানালেন, গত বছর গুরুমারা জাতীয় উদ্যানে এসেছিলেন ৬৬ হাজার পর্যটক।

এছাড়াও লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে পর্যটন আকর্ষণ এবং ডুয়ার্সের লোক সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যেই গত কয়েক বছর ধরে লাটাগুড়িতে শুরু হয়েছে উত্তরবঙ্গ লোকসংস্কৃতি উৎসব ও ডুয়ার্স প্রকৃতি পর্যটন মেলা। লাটাগুড়িতে ওঁরাও, খেড়িয়া, ওড়িয়াদের লোকসংস্কৃতি ও লোকনৃত্য, পনঝোড়ার নেপালী লোকসংস্কৃতি এবং ধূপঝোড়ার ভাওয়াইয়া গান আর আদিবাসী নৃত্যের ব্যবস্থাও করা হয় পর্যটকদের জন্য।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, অরণ্যকে কেন্দ্র করে পর্যটনের এই প্রসারের ফলে কি ক্ষতি হচ্ছে জঙ্গলের? বিপন্ন হচ্ছে পশু পাখিরা? এ প্রশ্ন অবান্তর নয়। অলীক নয় এই আশঙ্কাও। কিন্তু সুখের কথা, গত বছর সারা দেশের মধ্যে সেরা জাতীয় উদ্যানের শিরোপা পেয়েছে এই গোরুমারা জাতীয় উদ্যানই। ওয়াইল্ড লাইফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইকনমিক রিহ্যাবিলিটেশন-এ ১০০-র মধ্যে ৮৬ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে ৯৮ বর্গ কিলোমিটারের গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। ১৯৭৭ সালে যেখানে এই অরণ্যে একশৃঙ্গ গঙ্গারের সংখ্যা কমে হয়েছিল ৭টি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬টিতে। বাইসন, সম্বর, চিতল হরিণ, হাতি, লেপার্ড সবই কমেছিল। এখন বাইসন হাজার দেড়েকের বেশি। হাতি ৪০টি। চিতল হরিণ, লেপার্ড, সম্বর সবই বেড়েছে যথেষ্ট। আর তা পর্যবেক্ষণের জন্য এখন গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার। আগে ছিল মাত্র একটি, গোরুমারায়। এখন তারই সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে যাত্রাপ্রসাদ, মেদলা, চুকচুকি, চন্দ্রচূড়, চাপড়ামারি, কলোখাওয়ার মতো টাওয়ারগুলি। আর লাটাগুড়ি ছাড়াও পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে ধূপমোড়া, বাতাবাড়ি, পানঝোড়া, রামসাই, কালীপুর বনবস্তি এবং বিচাভাঙা বনবস্তিতেও। আর, লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে দুই থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে চাপড়ামারি, শিবচু, বান্দাপানি, নাথুয়া, খুট্টিমারি, গোরুমারার মতো অরণ্যগুলি। খাদের কিনার থেকে আজ যে আবার প্রকৃতি পর্যটনকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে লাটাগুড়ি, একথা আজ মানছেন স্থানীয় সব মানুষই।